Pages

Pages

১৪ জুল, ২০১১

চূড়োকে বলো না একা!


মুসা ইব্রাহীমের এভারেস্ট জয়ের প্রথম বর্ষপূর্তি উপলক্ষে QUBEE-র পৃষ্ঠপোষকতায় নর্থ আলপাইন ক্লাব কর্তৃক প্রকাশিত স্মারক 'যেমন দেখেছে বাংলাদেশ'-এ প্রকাশিত। প্রকাশকাল : মে  ২০১১।
————

‘দৃঢ় সংকল্প + অদম্য স্পৃহা + সহযোগিতা ও শুভেচ্ছা + টিমওয়ার্ক + চ্যালেঞ্জ জয় + অভিজ্ঞতা + সামর্থ্য = এভারেস্ট অভিযান’
না, এই ‘জটিল’ সমীকরণ কোনো গণিতবিদের তৈরি নয়, মাউন্ট এভারেস্টের দিকে রওনা হওয়ার দু মাস আগে শব্দের পর শব্দ যোগ করে মুসা ইব্রাহীম নিজেই সেটা সাজিয়েছিলেন। বাংলাভাষার সবচেয়ে বড়ো ব্লগ সামহোয়্যারইনে মাঝে মাঝেই লিখতেন মুসা, ইউনিকোডে লিপিবদ্ধ হতো তার স্বপ্নগুলো, বলা ভালো নিভৃতেই। তার সেই লেখাগুলো খুব যে পাঠক টেনেছিল, তা নয়। বরং প্রচ্ছন্ন এক হেলাফেলার সুর ছিল পাঠকের মন্তব্যমালায়। এরপর মাঝখানে ষাটটি দিন। ২০১০ সালের ২৪ মে তিরিশ বছরের তরুণটি উঠে গেলেন ২৯ হাজার ৩৫ ফুট উঁচুতে। পৃথিবী তার পায়ের নিচে। আর সামহোয়্যারইনে মুসার নিভৃত ব্লগটা তখন ব্লগারদের তীর্থ। সেই সঙ্গে দু মাস আগের আপাত জটিল সমীকরণটা দাঁড়ায় এইরকম—
‘দৃঢ় সংকল্প + অদম্য স্পৃহা + সহযোগিতা ও শুভেচ্ছা + টিমওয়ার্ক + চ্যালেঞ্জ জয় + অভিজ্ঞতা + সামর্থ্য = এভারেস্ট জয়!’

ব্লগমন্ডলে নতুন আগন্তুক
ব্লগ সবসময়ই ছুটে চলে সময়ের সঙ্গে, কখনও বা সময়েরও যেন আগে। সপ্রাণ এই দুরন্ত গতিই আসলে ব্লগের অক্সিজেন। পিলখানার গণহত্যা থেকে শেয়ারবাজারের ওঠানামা—ক্রিকেট থেকে ক্ষুদ্রঋণজাত রাগ—কোনো কিছুই খুব বেশি সময় ধরে ব্লগারদের আটকে রাখতে পারে না, কোনো কিছুই খুব বেশি সময় আলোচনার বিষয় হয়ে থাকে না। কিন্তু মুসা ছিলেন, ভালোভাবেই ছিলেন ব্যতিক্রমী উদাহরণ হয়ে—প্রশস্তিতে, বিতর্কে, প্রাণবন্ত আলোচনায়। সত্যি বলতে কী, বিশেষ কাউকে নিয়ে এভাবে উৎসবে মেতে ওঠার উপল আর আসেনি বাংলাভাষী ব্লগমন্ডলে। সাধারণ ব্লগাররা তো বটেই, এভারেস্ট চূড়োয় লাল-সবুজ পতাকার অভিষেক আপ্লুত করেছিল সামহোয়্যারইন ব্লগের কর্নধার আরিল ক্লকারহগকেও। বাংলা অন্তঃপ্রাণ এই নরওয়েজিয়ান মানুষটি মন্তব্যে লিখেন : ‘অভিনন্দন মুসা ইব্রাহীম! you are my new hero! i am just thinking about young guys from my cold and mountainous country: Norway. they start skiing when they are 2 years old, they grow up with snow and cold weather. they start climbing small rocks on the way back home from their play group. when they grow up, they have access to all kind of equipment, experienced trainers and a solid rock climbing community. still, if anyone of them climb Everest, they easily become national heroes.’

যেন নিজেদেরই বিজয়!
সামহোয়্যারইন ব্লগে মুসাকে তাৎণিক অভিনন্দন জানিয়ে একটি লেখা স্টিকি করা হয়েছিল। তাতে ব্লগারদের স্বতঃস্ফূর্ত মন্তব্য এসেছিল আড়াইশো। এরপর কম করে হলেও ব্লগারদের শতাধিক লেখা প্রকাশিত হয়েছে মুসাকে নিয়ে। এভারেস্ট বিজয় নিয়ে আমার নিজেরই একটি ব্যাখ্যামূলক লেখা পঠিত হয়েছিল ১০ সহস্রাধিক বার। এ থেকেই বোঝা যায় মুসাকে নিয়ে কতোটা গভীর আগ্রহ ছিল ব্লগমন্ডলে। পিছিয়ে ছিল না বাংলাভাষার অন্য ব্লগগুলোও। দলমতনির্বিশেষে সব ব্লগেই ব্লগাররা মেতে উঠেছিলেন উচ্ছ্বাসে—এ যেন তাদের নিজেদেরই বিজয়।
ঘরের কাছের এভারেস্ট চিরকালের অতি চেনা হয়েও সবার কাছে একরকম অনাত্মীয়ের মতোই ছিল। চারদিক চোখ-কান খোলা রাখা ব্লগারের জ্ঞানও ছিল বড়জোর মলিনপ্রায় কেওকারাডং পর্যন্ত, জানাশোনার পথ ধরে আরেকটু হাঁটলে বড়জোর নাতিদীর্ঘ সাফা হাফলং। মুসার বিজয়ের পর নতুন করেই যেন ধরা দিল এভারেস্ট, নতুন করে চেনা গেল পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু চূড়োটিকে। আর এই প্রথম আবিস্কার করা গেল পর্বতাভিযান নিয়ে ব্লগারদের মনে বিচিত্র সব জিজ্ঞাসা, অদ্ভূত সব প্রশ্নের পাহাড়। কাজেই বহুদিন ধরে চলল পর্বত অভিযান নিয়ে বিচিত্র সব আলোচনা—তাত্ত্বিক আলোচনা থেকে সাধারণ বিষয় আশয়—পিরামিড শ্যাডোর আকার-প্রকার থেকে মুসার প্রাণ বাঁচানো ব্রেন্ডান ওমামানিও বাদ থাকেনি। অন্নপূর্ণার আঠারো হাজার ফুটের পর পুরোটাই বরফ কিনা, কোন্ পদ্ধতিতে মেলে পর্বতারোহণের সনদ কিংবা এভারেস্ট কেন ‘চমলাংমা’, এমনকি এভারেস্ট চূড়োয় ব্যাটারির চার্জ থাকে না কেন সেটা নিয়েও দীর্ঘ আলোচনা চললো ব্লগারদের মধ্যে। মজার ব্যাপার হল, এক ব্লগারের প্রশ্নের উত্তরও আবার আরেক ব্লগারই দিয়েছেন—এভাবে এগিয়ে গেছে বিতর্ক, সপ্রাণ আলোচনা। এই করে করে বাঙালি ব্লগার নাম-ধাম-মাপেই কেবল এভারেস্ট চেনেনি, চিনেছে একেবারে জিপিএস লংগিচ্যুডসহই।
এমনিতে পাহাড়ের উচ্চতা দেখে হা-হুতাশ করা জাতি আমরা। ফলে মুসার বিজয় নিয়েও সন্দিহান থাকতে দেখা গেছে কাউকে কাউকে, বাঙালির চিরকেলে স্বভাব। এমনকি কূপমন্ডুক সতীর্থ অভিযাত্রীদের পৌরহিত্যে খানিকটা নোংরামিও ছুঁতে চেষ্টা করেছিল মুসার বিজয়কে। ডাঙ্গায় বসে মুসাকে এভারেস্ট থেকে টেনে ফেলে দেওয়ার চেষ্টাও কম চলেনি। বলাবাহুল্য, সশরীরে না থেকেও দিনশেষে মুসা সেখানেও বিজয়ী।

হয়ে আশার প্রদীপ
ব্লগ যদিও সিরিয়াস আলোচনার জায়গা, তবে মাঝে মাঝে সেখানেও ঘটে অদ্ভূত সব কাণ্ডকারখানা। কিছুদিন আগে হঠাৎ করেই এক ব্লগার লিখে বসলেন, তিনি আত্মহত্যা করতে চান। যাপিত জীবন নিয়ে ভুগছেন চরম হতাশায়। আতঙ্কিত হওয়ার কথাই। সেই আতঙ্ক থেকে সহ-ব্লগারদের অনেকে তাকে নানান আশার বাণী শোনালেন। কেউ কেউ জোগালেন সান্ত্বনা। শেষে এক ব্লগার লিখলেন—‘যে দেশে মূসা ইব্রাহীমের মতো তরুণ কারো সাহায্য ছাড়াই এভারেস্ট জয় করে আসতে পারে, সেই দেশের তরুণ হয়ে আপনি কেন কাপুরুষতার পথে হেঁটে আত্মহনন করবেন?’ আত্মহত্যাপ্রবণ সেই ব্লগার মন্তব্যের জবাব দেননি, হতে পারে লজ্জায়, তবে এর চেয়ে ভালো জবাবও কি আর হয়? হোক বা না হোক, মুসা কিন্তু হয়ে উঠেছেন জীবন্ত উদাহরণ, তারুণ্যের কাছে আশার প্রদীপ। ছোট্ট এক মন্তব্যে এক ব্লগারের আশাবাদ, মনে পড়ে এখনও—‘বাংলাদেশ ভরে যাক মুসার মতো ‘কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হওয়া’ ছেলে এবং মেয়েতে।’

নিঃসঙ্গ শেরপা
ব্লগে বসলে লোডশেডিং, সড়কজুড়ে অসহনীয় যানজট, পথে-ফুটপাতে ক্ষুধার্ত মুখের সারি—এই যখন বাংলাদেশের প্রকৃত চিত্র—এভারেস্ট জয় সেখানে অসামান্য কোনো ঘটনা নয়। বরং সেটা একটি প্রেরণা—জয়ের জন্য অদম্য চেষ্টা চালানোর প্রেরণা। ক্ষুধা-দারিদ্র-সমস্যাকে রুখে দাঁড়ানোর সাহস। মুসার অর্জন আমাদের আশা দেয়। সমস্যাজর্জর এই দেশে এইটুকুন আশা জোগানোর মূল্য যে কতোটা, সেটা ঠিক এখনই বুঝে উঠতে পারবেন না অনেকেই, তবে নিশ্চিত একদিন! আমরা তো দেখেছি, যা করার মুসা একাই করেছেন। সবকিছুর জোগাড়যন্ত্র তো বটেই, এমনকি নিজের প্রাণটা বাজি রাখা পর্যন্ত। প্রিয় পরিবারকে রেখে মুসা যখন বেসক্যাম্পের পথ ধরেছেন, তখনও তিনি একাই—নিঃসঙ্গ শেরপা, পাশে ছিল না কেউই। কিন্তু লেগে থাকলে কোনোকিছুই অসম্ভব নয়—আগামী দিনের নাগরিকদের জন্য উদাহরণটি মুসা নিজে হাতেকলমে তৈরি করে দিয়েছেন। নিশ্চিত আমি, অসম্ভবকে সম্ভব করে মুসার এই অর্জনটুকু হতাশ তারুণ্যকে উদ্যমী হয়ে উঠতে সাহায্য করবে।

এভারেস্ট বহু বছর ধরে ১৬ কোটি মানুষের দেশ থেকে বিশেষ কারো অপেক্ষায় ছিল। কে না জানে, সেই অপেক্ষার কালও ফুরিয়েছে। বলে তো দেওয়াই যায়—‘চূড়োকে বলো না একা, শীর্ষে তার মুসা ইব্রাহীম!’

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন