টিফা থেকে টিইসিএফ : অসৎ সরকার আর মার্কিন শকুনের চোখ এখন দুই কোটি কম্পিউটার ব্যবহারকারীর ওপর

মধ্যরাত। দরজায় ঠকঠক শব্দ। ওপাশে টের পাওয়া যায় কালো পোশাকের কিছু মানুষের আনাগোনা । দরজা খুলতেই হড়হড় করে ঢুকে পড়ে একপাল র্যাব। কয়েকজোড়া আতঙ্কিত চোখের সামনে দ্রুতই ঘরের কোণে আসন গাড়া কম্পিউটার মনিটরটা চালু হয়। মাইক্রোসফট ওয়ার্ডের লাইসেন্স আছে কিনা - সেটা নিশ্চিত হতে সশস্ত্র র্যাবের খুব বেশি সময় লাগে না। অতঃপর কলেজপড়ুয়া ছেলেটার হাত দুটো প্রার্থনার ভঙ্গিতে এক হয় স্টেইনলেস স্টিল হাতকড়ার বন্ধনে।

এমন দৃশ্য ঠিক এই মুহূর্তে হাস্যকর মনে হতে পারে। কিন্তু নিশ্চিত করে বলতে পারি, এই দৃশ্য খুব শীঘ্রই দেখা যাবে এই বাংলাদেশে। ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা কিংবা রাজশাহীই শুধু নয়, কিম্ভূত এক চুক্তির জাল থেকে রেহাই পাবে না বাংলাদেশের কোনো কম্পিউটার ব্যবহারকারীই।

টিফা থেকে টিইসিএফ
এর আগে বহু চেষ্টার পরও গণমানুষের বিক্ষোভের মুখে সরকার টিফা চুক্তি করতে পারেনি। ধুরন্ধর সরকার সাধারণ মানুষের চোখে ধুলো দিয়ে আবার সেই একই চুক্তির পসরা নিয়ে ওয়াশিংটন-ঢাকা আসা-যাওয়া শুরু করেছে। চুক্তির নামটিও প্রস্তাব করেছে সরকার নিজেই। মার্কিন সরকার নামটা টিফাই রাখতে চেয়েছিল, কিন্তু বাংলাদেশের ধূর্ত আমলারা একটু বদলে নাম দিয়েছে 'টিইসিএফ'। একটু নতুন মোড়কে সেই একই মালমসলা। চুক্তির সবকিছুই আসলে শেষপর্যায়ে। সরকার পক্ষে যারা এই চুক্তির সঙ্গে জড়িত, তারা বিষয়টা নিয়ে লুকোচুরি করতে চাইছে, যেন এ নিয়ে কোনো বাদ-প্রতিবাদ না হয়। অর্থ, বিশেষ করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়েই এখন সামান্য আটকে আছে চুক্তির সবকিছু চূড়ান্ত হওয়াটা। সেটাও এখন শ্রেফ সময়ের ব্যাপার। কারণ খোদ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে বারবার তাগাদা দেওয়া হচ্ছে এই চুক্তির প্রক্রিয়া এগিয়ে নেওয়ার জন্য। প্রধানমন্ত্রীর অর্থবিষয়ক উপদেষ্টা মসিউর রহমান সম্ভাব্য চুক্তিটির অগ্রগতি হচ্ছে না কেন, জানতে চেয়ে বাণিজ্যমন্ত্রী মুহাম্মদ ফারুক খানের কাছে সম্প্রতি একটি চিঠি পাঠিয়েছেন। চিঠিতে তিনি বারবার আলোচনা ভেঙে গেলে পারস্পরিক অনাস্থা তৈরি হওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করেন। প্রধানমন্ত্রীর এই অর্থ উপদেষ্টা যেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিযুক্ত ভৃত্য! আর এই যে অর্থমন্ত্রী কিংবা বাণিজ্যমন্ত্রী তাদের কথোপকথনের শেষাংশে 'অবশ্যই দেশের স্বার্থ রক্ষা হবে' বলে যে বাণীটি উচ্চারণ করছেন নিয়ম করে, সেটাও ওই কথার কথাই। রাজনৈতিক বুলি মাত্র। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সফর করতে পারলেই আমাদের বাণিজ্য সচিবের খুশিতে ডগমগ করার কথা। দেশের স্বার্থের কথা চিন্তা করার সময় কোথায় তার? বরং খোঁজ নিলে হয়তো দেখা যাবে, এই চুক্তির বিনিময়ে অবসরে যাওয়ার পর তিনি যুক্তরাষ্ট্রের সাহায্যপুষ্ট কোনো প্রতিষ্ঠানে চাকরির নিশ্চয়তা নিয়ে এসেছেন।

চুক্তিটা যে কারণে স্পর্শকাতর
টিইসিএফ চুক্তির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও প্রধান বিষয় হল মেধাস্বত্ব আইনের পূর্ণ বাস্তবায়ন। স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে বাংলাদেশ বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) কাছ থেকে কিছু ছাড় ও সুবিধা পেয়ে আসছিল। এর একটি হল ২০১৩ সালের ১ জুলাইয়ের আগ পর্যন্ত বাংলাদেশকে কপিরাইট, ট্রেডমার্ক, পেটেন্টসহ অন্য কোনো মেধাস্বত্ব বিধি প্রয়োগ করতে হবে না। বাংলাদেশে তথ্যপ্রযুক্তির যেটুকু প্রসার হয়েছে, তা মূলত এই সুবিধার কারণেই। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাবিত টিইসিএফ চুক্তি স্বাক্ষর হওয়া মাত্রই বাংলাদেশে মেধাস্বত্ত্ব বিধি কার্যকর হয়ে যাবে। তাতে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার হয়ে উঠবে অকল্পনীয়ভাবে ব্যয়বহুল। কম্পিউটারে ব্যবহৃত প্রতিটি সফটওয়্যারেরই লাইসেন্স নিতে হবে চড়া মূল্যে। শুধু তাই নয়, কৃষিসহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সব সম্ভাবনাময় খাত যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে চলে যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে। কারণ ট্রেড রিলেটেড আসপেক্টস অব ইনটেলেকচুয়াল প্রোপার্টি রাইটসের (ট্রিপস) নামে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির নানা ক্ষেত্রে নানা স্বত্ব তৈরি করে রেখেছে যুক্তরাষ্ট্র। আবার তথ্যপ্রযুক্তিই শুধু নয়, দেশের সম্ভাবনাময় ওষুধশিল্পও এই চুক্তির অনলে পুড়বে। স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে ওষুধের ক্ষেত্রে ২০১৬ সাল পর্যন্ত পেটেন্টের কোনো বাধ্যবাধকতা নেই বাংলাদেশের ওপর। টিইসিএফ চুক্তি হলে সেটা অকার্যকর হয়ে পড়বে। তাতে ওষুধ উৎপাদনকারী অনেক প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাবে। ওষুধের দামও অনেকগুণ বেড়ে যাবে।

দেশবিরোধী চুক্তিতে সরকারের কেন এতো আগ্রহ
এটা কারও অজানা নয় যে, ইউনূস ইস্যুতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একটা শীতল সম্পর্ক যাচ্ছে এই সরকারের। এর জের হিসেবে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারী ক্লিনটন পার্শ্ববর্তী ভারত সফরে এলে ঘন্টাখানেকের জন্যও তাকে বাংলাদেশের আনতে রাজি করাতে পারছে না সরকার, এমনকি মার্কিন প্রশাসনে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়েও। ফলে সরকার এখন যে কোনো মূল্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ হতে চাইছে। সরকারের অসহায়ত্ব বুঝে যুক্তরাষ্ট্রও এই ফাঁকে চুক্তিটা করিয়ে নিতে চায়। মার্কিন-ভক্ত প্রমাণের জন্য সরকার এখন বাংলাদেশের মানুষের পশ্চাৎদেশটা মেরে মার্কিনীদের স্বার্থ রক্ষা করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে।

সামনে তাহলে কী ঘটতে যাচ্ছে?
বিজয় সফটওয়্যারের মেধাস্বত্ত্ব নিয়ে এক মোস্তফা জব্বারের অশ্লীল বিলাপ ছাড়া বাংলাদেশে সেভাবে আর কিছু দেখা যায় না। কিন্তু টিইসিএফ চুক্তির মূল বিষয় যেহেতু মেধাস্বত্ত্বের পূর্ণ বাস্তবায়ন, সে কারণে দরিদ্র দেশ বাংলাদেশ আর তার প্রতিটি কম্পিউটার ব্যবহারকারীকে এই মেধাস্বত্ত্বের ধকল পোহাতেই হবে। সবদিক থেকেই তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার হয়ে দাঁড়াবে চরম ব্যয়বহুল। আগামী বছর থেকেই হয়তো একটা কম্পিউটারের সঙ্গে লক্ষাধিক টাকার সফটওয়্যার কিনতে হবে। ওয়ার্ড-এক্সেল মিলিয়ে মাইক্রোসফট অফিসটা কিনতে গেলে আপনাকে গুণতে হবে প্রায় ৪০ হাজার টাকা। আরেকটু কম সুবিধাসম্পন্ন প্যাকেজ কিনতে হলে কমপক্ষে ২০ হাজার। কেবল এডবি ফটোশপেরই সর্বশেষ সংস্করণের দাম পড়বে মাত্র ৫১ হাজার টাকা। এর চেয়েও ভয়ংকর বিষয় হল, চুক্তি হলে এমন এমন সব জিনিস তখন কপিরাইট আইনের আওতায় চলে আসবে, যা ঠিক এই মুহূর্তে ভাবাটাও খুবই কঠিন। বিধি কার্যকর হলে সেটা বাস্তবায়নের ব্যাপারটাও আসে। কাজেই এটা খুব স্বাভাবিক যে, মার্কিন সরকারের আয়োজনে মাইক্রোসফট-এডবির অর্থায়নে খুব শীঘ্রই RAB-পুলিশ-ম্যাজিস্ট্রেটদের পাইরেটেড সফটওয়্যার শনাক্ত করার প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। অনুদান দেওয়া হবে থানাগুলোতে। সরকারের চাঁইদের পকেটটা ফুলিয়ে দেওয়া হবে ডলারে ডলারে। প্রাপ্তির তুলনায় এই বিনিয়োগ সামান্যই হবে বলতে গেলে।

দেশি-বিদেশি শকুনদের টার্গেট কারা
বিটিআরসির তথ্য অনুসারে বাংলাদেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারী এখন প্রায় এক কোটি। ২০১৪ সালে সেটা আড়াই কোটিতে গিয়ে দাঁড়াবে। পরিসংখ্যান না থাকলেও সবমিলিয়ে কম্পিউটার ব্যবহারকারীর সংখ্যা এখনই অন্তত দুই কোটি হবে। এদের বেশিরভাগই তরুণ। এই তরুণরাই এখন মার্কিন বাণিজ্য শকুনদের টার্গেট।
পকেটে টাকা নেই, দু বেলা খাওয়ার পয়সা নেই, চাকরির সুযোগ নেই, তবু উপায়হীন তরুণরা কম্পিউটারটা শিখছিল খেয়ে না খেয়েই। ৩০ হাজার টাকা দিয়ে যদি তাদের মাইক্রোসফট অফিসটা কিনতে হতো, তাহলে গরিব এই দেশে কম্পিউটার ব্যবহারকারীর সংখ্যা হতো হাতেগোনা। যে ছেলেটা এই ঢাকায় মাসের শেষে মেস ভাড়াটা ঠিকমতো দিতে পারে না, শীঘ্রই তাকে ৪০ হাজার টাকা খরচ করে মাইক্রোসফট ওয়ার্ডের লাইসেন্স কিনতে হবে। দিনরাত জেগে অমানুষিক পরিশ্রম দিয়ে বাংলাদেশের তরুণরা আউটসোর্সিংয়ের কাজে নেমেছিল। সেখান থেকে মেসে থাকা তরুণের ইন্টারনেট বিলটা আসছিল, কেউবা আয় করছিলেন দু পয়সা। হঠাৎ করেই সেদিকে নজর পড়ল সরকারের। তড়িঘড়ি ট্যাক্স বসিয়ে দেওয়া হল তার ওপর। এখন শুধু ট্যাক্স নয়, পুলিশ লেলিয়ে দেওয়া হবে তাদের পেছনে।

সুতরাং!
অপেক্ষায় থাকুন, আগামী মাসেই মার্কিন প্রতিনিধিদল বাংলাদেশে আসছে, সরকারও প্রস্তুত - মাত্রই শৈশব-উত্তীর্ণ তথ্যপ্রযুক্তি অঙ্গনকে বলাৎকার করার সব আয়োজন মোটামুটি সম্পন্ন। বাদ-প্রতিবাদ নয়, সম্ভব যদি হতো নিজ হাতে কয়েকটা খুন করে ফেরার হতাম নিশ্চিত!

Tags: , , ,

About author

ফিউশন ফাইভ। ব্লগ লিখছেন পাঁচ বছরেরও বেশি সময় ধরে।

0 মন্তব্য

Leave a Reply