মুসা ইব্রাহীমের এভারেস্ট অভিযান : বামনকূলের ২০ প্রপাগাণ্ডা নিয়ে একটি পোড়ামাটি অনুসন্ধান - পর্ব : ২






মুসা ইব্রাহীম সামহোয়্যারইনেরই ব্লগার, আগে কখনো নজর কাড়েননি সেভাবে। আজ এই তুমুল তরুণের ব্লগে গিয়ে দেখলাম, প্রতিটি অক্ষরে অক্ষরে কী অদ্ভূতভাবে ছড়িয়ে ছিল পৃথিবীর সর্বোচ্চ চূড়া জয়ের সুকঠিন প্রতিজ্ঞা! প্রোফাইলে লিখে রেখেছেন- 'লক্ষ্য ২০১০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ থেকে এভারেস্ট জয় করা।' এখন সেটা ইতিহাস! প্রথম বাংলাদেশী হিসেবে মুসা ইব্রাহীমের এভারেস্ট বিজয়ের পর সামহোয়্যারইন ব্লগ ছাড়াও কয়েকটি ছোট ব্লগে বেশ কিছু প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে। নেটজগতের বাইরে এইসব চিৎকার-চেঁচামেচি একেবারেই মূল্যহীন। তবুও একজন নেটিজেন হিসেবে আমার মনে হয়েছে, এই পরিস্থিতিতে পুরো বিষয়টি সম্পর্কে একটি পোড়ামাটি অনুসন্ধান জরুরি। অনুসন্ধানের স্বার্থে মুসা ইব্রাহীম ছাড়াও তার সঙ্গে যাওয়া শেরপা, তার কাছের বন্ধুবান্ধব, ঘনিষ্ঠজন এবং ঢাকাভিত্তিক পর্বতারোহীদের সঙ্গে কথা বলেছি। সেগুলো আবার যাচাই-প্রতিযাচাই করেছি যথাসম্ভব। সেদিকে সময়ও লেগে গেছে বেশ খানিকটা। ওয়েবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা তথ্য খুঁজেপেতেও সময় লেগেছে, তবে কার্পণ্য করিনি কিছুতেই।

প্রপাগাণ্ডা ১ থেকে ৯ নিয়ে ছিল প্রথম পর্ব। এবার দ্বিতীয় পর্ব।

কক্সবাজারে অবকাশ, কৃতজ্ঞতা অথবা উৎকোচ
প্রপাগাণ্ডা ১০ : এভারেস্ট অভিযানের সঙ্গী তিন শেরপাকে মুসা বাংলাদেশে শুধু আমন্ত্রণই জানাননি, বেড়াতে নিয়ে গেছেন কক্সবাজার সৈকতে। অথচ তার প্রাণ রক্ষা করেছেন যে ব্রেণ্ডান ওম্যামানি আর স্টিফেন গ্রিন, তাঁদের সম্পর্কে তিনি একেবারেই নিরব। একটি বারও তিনি তাদের নাম ধরে এখন পর্যন্ত কোথাও লেখেননি। বাংলাদেশে এই তিন শেরপা গাইডের জন্যে ভ্রমণের আয়োজন কি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ, নাকি কোনো ধরনের উৎকোচ?
অনুসন্ধান : এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ থাকা উচিত নয় যে, ওই তিন শেরপা না থাকলে মুসার এভারেস্ট সামিট হতো না। পুরোটা সময় তারা তাকে মানসিকভাবে সাহস জুগিয়েছেন। যার যে দায়িত্ব সেটা তারা পালন করেছেন। প্রয়োজনে তাকে বকাবকিও করেছেন। এভারেস্ট টপ থেকে কিছুটা নিচে যখন পাথরে ঘষা খেয়ে মুসার অক্সিজেনের নল ফুটো হয়ে গিয়েছিল তখন সেটা মেরামত করে তার প্রাণ বাঁচিয়েছিল সঙ্গে থাকা দুই শেরপাই। আর নামার সময় মাস্কে বেশি নাড়াচাড়ার ফলে বেশ কিছু জায়গায় বরফ জমে গিয়ে মুসার যখন নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল, প্রচন্ড পানির তৃষ্ণায় যখন তিনি কাতর, তখন তাকে পানি আর পাওয়ার জেল খাইয়ে একটু চাঙ্গা করে তোলে স্টিফেন গ্রিন এবং ব্রেণ্ডান ওমামানি। তখনও মুসার সঙ্গে শেরপা ছিল। কিন্তু শেরপাদের পানিও শেষ হয়ে যাওয়ায় গ্রিন আর ওমামানির সাহায্য তখন খুব কাজে লেগেছিল। এই ছবিতে দেখুন এভারেস্ট চূড়া বিজয় শেষে নেপালে মুসা ইব্রাহীমের সঙ্গে ওই দুজনকে।

অনুসন্ধানে জেনেছি, মুসা তার এভারেস্ট অভিযানের সঙ্গী তিন শেরপাকে বাংলাদেশে আমন্ত্রণ জানিয়ে এবং কক্সবাজার বেড়াতে নিয়ে গিয়ে তাদের প্রতি যে ধরনের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন, একই ধরনের কৃতজ্ঞতা ব্রেন্ডান ওমামানি ও স্টিফেন গ্রিনের কাছেও প্রকাশ করেছেন ওই একই সময়ে বাংলাদেশে ভ্রমণের আমন্ত্রণ জানিয়ে। কিন্তু তারা সময় বের করতে না পারায় মুসা ইব্রাহীমের অনুরোধ রক্ষা করতে পারেননি। তবে গ্রিন ও ওম্যামানি আর তাদের দলের সঙ্গে নেপালের বিখ্যাত রামডুডল হোটেলে দেখা হলে সেখানে তাদের বাংলাদেশের মানুষের পক্ষ থেকে ধন্যবাদ জানানো হয়, কৃতজ্ঞতার নিদর্শন স্বরূপ তাদের মাথায় লাল সবুজের ব্যান্ডানা পরিয়ে দেন মূসা ইব্রাহীম। দীর্ঘক্ষণ ধরে তারা সাংবাদিকদের কাছে সাক্ষাৎকার দেন এবং তখনকার ঘটনা বর্ণনা করে। সেদিন সন্ধ্যাতেই ছিল নেপালস্থ বাংলাদেশ দূতাবাসের আয়োজনে মুসা ইব্রাহীমের সংবর্ধনা। সেই সংবর্ধনায় গ্রিন আর ওমামানিকেও আমন্ত্রণ জানানো হয়। তারা যথাসময়ে মুসার জন্য উপহার হাতে হোটেল এভারেস্টের সংবর্ধনায় হাজির হন। মুসা ইব্রাহীমের অনুরোধে তারাও মঞ্চে আসন গ্রহণ করেন। পরে মুসা ইব্রাহীম ও উপস্থিত বাঙালিরা তাদের সঙ্গেই বাংলাদেশ ভ্রমণের আমন্ত্রণ জানায়। কিন্তু সময়ের টানাটানি থাকায় তারা অপারগতা প্রকাশ করলেও ভবিষ্যতে তারা বাংলাদেশে আসবেন এই কথা জানান। বাংলাদেশী পর্বতারোহীদের অনেকেই বলেছেন, শেরপাদের এদেশে ভ্রমণ করাটাকে উৎকোচ ভাবা অত্যন্ত অরুচিকর একটি সন্দেহ, যেখানে বাংলাদেশীরা অতিথিপরায়ণ হিসেবে বিশ্বখ্যাত। এখানে আরেকটি তথ্য, পর্বতারোহীদের অপর একটি সংগঠনের আমন্ত্রণে রেকর্ডধারী শেরপা পেমবা দর্জি একাধিকবার বাংলাদেশে এসেছেন সাম্প্রতিককালে। একে কি আমরা 'উৎকোচ' ভেবে সন্দেহ করতে পারি?

হিমালয়ান গাইডসের ওয়েবসাইটে অস্বাভাবিক নোটিশ
প্রপাগাণ্ডা ১১ : সাধারণত অভিযান আয়োজক প্রতিষ্ঠানগুলো বরাবরই তাদের ওয়েবসাইটে শিখরজয়ীদের নামের তালিকা প্রকাশ করে। কিন্তু হিমালয়ান গাইডস একটি অভূতপূর্ব ব্যতিক্রম ঘটিয়েছে মুসার ক্ষেত্রে। মনোযোগী পাঠক এখানে একটু লক্ষ করলেই দেখবেন, ১৭ মে ও ২৫ মে এভারেস্ট শিখরজয়ীদের প্রত্যেকের নামের একটি পূর্ণাঙ্গ তালিকা এসেছে। এ দুয়ের মাঝখানে আমরা দেখতে পাচ্ছি, ২৬ জনের H.G. International Everest Expedition ২০১০ দলের ২৫ জনকেই উপোর অন্ধকারে ঠেলে ফেলে দিয়ে এক ও একক মুসা ইব্রাহীমের কীর্তির জয়গান গাওয়া হয়েছে। মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, মুসা কি হিমালয়ান গাইডসের কোনো বিশেষ মক্কেল? এমন একজন ক্লায়েন্ট, যার নামটি অভিযাত্রী দলের একজন হিসেবে না এসে একটি পৃথক ভুক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠানটির ওয়েবসাইটে যুক্ত হয়? পাঠকের প্রশ্ন, হিমালয়ান গাইডস কেন এ ধরনের অস্বাভাবিক নোটিশ ইস্যু করলো? মুসা ইব্রাহীমই বা কেন বিশেষ একজন মক্কেল হতে যাবেন?
অনুসন্ধান : মুসা ইব্রাহীমের এভারেস্ট জয়ের খবর বাংলাদেশে পৌঁছানোর পর এদেশের আরেকজন পর্বতারোহী সজল খালেদ একটা ই-মেইলে বেশ কিছু কারণ উল্লেখ করে এই খবর কেন বিশ্বাসযোগ্য নয় এবং সন্দেহজনক, তা সবার কাছে ব্যাখ্যা করেছিলেন। সজল খালেদ বলেছিলেন, মুসা ইব্রাহীম চায়না-তিব্বত মাউন্টেনিয়ারিং অ্যাসোসিয়েশন থেকে সনদ পেলে তবেই তার এভারেস্ট জয়কে বিশ্বাস করা যেতে পারে। এরপর তিনি অবশ্য ক্ষমা চেয়ে সবার কাছে ই-মেইল করেছেন যখন মুসা ইব্রাহীমের এভারেস্ট জয়ের খবর সন্দেহাতীতভাবে নিশ্চিত হয়ে নেপালে বাংলাদেশ হাইকমিশন এক বার্তায় তা দেশে পৌঁছে দিয়েছিল। কিন্তু এ সময়ে বিএমটিসি, ইনাম আল হক, সজল খালেদ, মুনতাসির মামুন ইমরান, মীর শামসুল আলম বাবু তখনও বিভিন্ন ব্লগে সরব ছিলেন এই বলে যে কোনো ওয়েবসাইট এখনও (২৫ মে ২০১০) যেহেতু মুসা ইব্রাহীমের এভারেস্ট জয়ের খবর প্রচার করেনি, সুতরাং তা বিশ্বাসযোগ্য নয়। তাদের নেতিবাচক প্রচারণায় অতিষ্ট হয়ে বাংলাদেশ থেকে মুসার বন্ধুরা তখন নেপালে অবস্থানরত নর্থ আলপাইন ক্লাব বাংলাদেশের সভাপতি আনিসুল হককে অনুরোধ করেন, হিমালয়ান গাইডসের ওয়েবসাইটে মুসার খবরটা ‘আপ’ করার ব্যাপারে হিমালয়ান গাইডসকে তাড়া দিতে। আনিসুল হক যখন পুরো পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করে হিমালয়ান গাইডসের স্বত্ত্বাধিকারী ঈশ্বরী পাউডেলকে অনুরোধ করেন তখন তিনি হেসেই বাঁচেন না। তার কথা, একটা লোক এভারেস্টে উঠেছে কি উঠে নাই এটা ওয়েবসাইটে দেখিয়ে তোমাদের দেশের মানুষকে বিশ্বাস করাতে হবে? আচ্ছা ঠিক আছে আমি বিশেষ গুরুত্ব দিয়েই মুসার খবর ‘আপ’ করার ব্যবস্থা করছি। যাদের জন্য বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে এই খবর ‘আপ’ করা হলো তারাই এখন এখন বলছে এত গুরুত্ব দেওয়া হলো কেন। অনুসন্ধানকালে এখানে ভিন্ন কোনো রসায়নের খোঁজ পাইনি। তারপরও পাঠকদের মধ্যে কারো যদি সন্দেহ বর্তমান থাকে, তিনি চাইলে বিষয়টা নিয়ে হিমালয়ান গাইডসের প্রধান ঈশ্বরী পাডওয়েলের (উনি কিন্তু জলজ্যান্ত পুরুষ, মহিলা নন) সঙ্গে যোগাযোগ করে দেখতে পারেন। তার ঠিকানা : Himalayan Guides Nepal: Treks & Expedition Pvt. Ltd. P.O. Box No: 20654, Thamel, Kathmandu, Nepal. Tel. : 4268211, 4260205, Fax : 00977-1-4260205, himguidenp@hons.com.np, basecamp@hons.com.np, http://www.himalayanguides.com
মুসা সম্পর্কে পবর্তারোহণ বিষয়ে বিশ্বের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য ও বিখ্যাত সাইট এক্সপ্লোরারওয়েবের দুটি লিংক এখানে প্রাসঙ্গিক বলে মনে করছি - প্রথম লিংক | দ্বিতীয় লিংক

২৫ বনাম ৪৬ লাখ টাকা
প্রপাগাণ্ডা ১২ : আচ্ছা, একই সময়ে এভারেস্ট অভিযানে থাকা পর্বতারোহী এমএ মুহিত ২৫ লাখ টাকা নিয়ে গেছেন একই পথ ধরে। মুসার দাবি অনুযায়ী, তিনি নিয়ে গিয়েছিলেন ৪৬ লাখ টাকা। অন্যদিকে এক মন্তব্যে সজল খালেদ জানাচ্ছেন, বিশ্ববিখ্যাত গাইডের প্রতিষ্ঠান ছাড়া এই খরচ হতে পারে সর্বোচ্চ ষোল-বিশ লাখ টাকা। সবমিলিয়ে তফাতটা বেশ বড়সড়, এখানে নিশ্চয়ই কোনো গোজামিল আছে!
অনুসন্ধান : খোঁজ নিয়ে দেখেছি, পর্বতারোহী এমএ মুহিতের এভারেস্ট অভিযানে শুধু ট্রান্সকম বেভারেজই ২৫ লাখ টাকা দিয়েছে। বিটিএমসির ইনাম আল হকও প্রথম আলো কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত এক সভায় নিজেই এ তথ্য জানিয়েছিলেন। মুহিতের অন্যান্য স্পন্সর সিটি ব্যাংক ও আকিজ গ্রুপও তাকে অভিযানের জন্য বড়ো অংকের টাকা দিয়েছিল। তাহলে মুহিত শুধু ২৫ লাখ টাকা নিয়ে গেলেন কিভাবে? অবশ্য সিটি ব্যাংক আর আকিজ গ্রুপের টাকাটা অন্যভাবে পকেটস্থ হয়েছে কিনা- সে ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
তবে মুসা ইব্রাহীম এভারেস্ট অভিযানের জন্য নিয়ে ৪৬ লাখ টাকাই নিয়ে গিয়েছিলেন। এর মধ্যে এভারেস্ট অভিযান করতে সরকারিভাবে ফি জমা দিতে হয়েছে দশ হাজার ডলার। প্রতি শেরপার বেতন পাঁচ হাজার ডলার করে (৫X৩=১৫ হাজার ডলার)। আর নর্থ ফেস দিয়ে হিমালয়ান গাইডের এভারেস্ট অভিযানের প্যাকেজের খরচ ৩৮ হাজার ডলার (যার ভেতর যাওয়া-আসা, খাওয়া-দাওয়া, থাকা ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত)। এছাড়াও পর্বতারোহণ সরঞ্জাম কেনা ও ইন্স্যুরেন্স করতেও খরচ হয়েছে ২১০০ ডলার। এবার ডলারগুলোকে বাংলাদেশের টাকায় কনভার্ট করলে মুসা ইব্রাহীমের দাবির সত্যতাই প্রমাণ হয়। এমনিতে এভারেস্ট অভিযানে কত খরচ হয় সেটা আরও বিস্তারিত জানতে যে কেউ গুগলে সার্চ দিয়ে দেখতে পারেন। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান তাদের ওয়েবসাইটে এভারেস্ট অভিযানের খরচ কতো, তা সেখানেই দিয়ে রেখেছে।

সার্টিফিকেটের ভাষায় অসঙ্গতি
প্রপাগাণ্ডা ১৩ : সব বুঝলাম। কিন্তু মুসার সার্টিফিকেটের ভাষায় তো অসঙ্গতি রয়েছে বলে শুনেছি। এমনকি এক সার্টিফিকেটে যেখানে 'এভারেস্ট' লেখা, ঠিক সেই জায়গায় মুসার সার্টিফিকেটে কেন ‌'চমলাংমা' লেখা?
অনুসন্ধান : সজল খালেদ যখন দেশে বসে মুসা ইব্রাহীমের এভারেস্ট জয়ের সংশয় ও সন্দেহ নিয়ে তার অপপ্রচারে ব্যস্ত, তখন দেশের সাংবাদিকরা মুসা ইব্রাহীমের কাছ থেকে (মুসা তখন বেস ক্যাম্পে) তার এভারেস্ট জয়ের সনদের ভাষা মোবাইল ফোনে জেনে নিতে ব্যস্ত। উদ্দেশ্যটা ছিল সংশয়বাদীর সংশয় দূর করার সর্বৈব প্রচেষ্টা চালানো। এটা করতে গিয়ে মোবাইল ফোনে সাংবাদিকরা এভারেস্ট জয়ের সনদের ভাষা শুনে নোট নিয়েছেন এবং তা তিন চার হাত বদল হয়ে পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। এর মধ্যে ভাষায় কোনো বিচ্যুতি ঘটলে তার দায় কার ঘাড়ে পড়ে? মুসার, নাকি পত্রপত্রিকার? অনুসন্ধানকালে মুসার সার্টিফিকেটের ভাষায় কোনো অসঙ্গতি খুঁজে পাইনি। ওই একই রুট দিয়ে এভারেস্ট জয় করা অন্যান্যদের সার্টিফিকেট আর মুসার সার্টিফিকেটের ভাষা একই। নিচের ছবি দুটো দেখুন-
সার্টিফিকেটের ছবি ১ | সার্টিফিকেটের ছবি ২
আর অনেকেরই নিশ্চয়ই এটা জানা আছে যে, মাউন্ট এভারেস্টকে বিভিন্ন নামে ডাকা হয়ে থাকে। নেপালিরা ডাকে 'সাগরমাতা', তিব্বতে ডাকা হয় 'ঝুমুলাংমা' 'চমলাংমা' ইত্যাদি নামে। এই পার্থক্যের বিষয়ে আরো ভালোভাবে জানা যাবে উইকিপিডিয়ার এই ভুক্তি থেকে।

সার্টিফিকেটের ওজন পরিমাপ
প্রপাগাণ্ডা ১৪ : আচ্ছা, অসঙ্গতি না হয় নাই বা থাকলো, কিন্তু পর্বতারোহীর অনুপস্থিতিতে তার ট্যুর অপারেটরই যেখানে সার্টিফিকেট সংগ্রহ করতে পারেন, সেখানে সার্টিফিকেটের গুরুত্ব কতটুকু?
অনুসন্ধান : পর্বতারোহীর অনুপস্থিতিতে ট্যুর অপারেটর সার্টিফিকেট কখন সংগ্রহ করে? এর উত্তর কি জানা আছে কারো? একটা ট্যুর অপারেটর পর্বতারোহীর অনুপস্থিতিতে তখনই সার্টিফিকেট সংগ্রহ করে, যখন সেই পর্বতারোহী সম্পর্কে লিয়াজোঁ অফিসার এবং শেরপারা সাক্ষ্য দেয় যে তিনি সেই পর্বতে উঠেছেন। ট্যুর অপারেটরই যদি ‘যেনতেনভাবে’ সার্টিফিকেট সংগ্রহ করতে পারতেন, তাহলে বাংলাদেশেই ‘এভারেস্ট বিজয়ী’র সংখ্যা হাজারদশেকের ঘরে পৌঁছাতো নিশ্চিত!

প্রমাণের অস্পষ্টতা কিংবা সুস্পষ্টতা
প্রপাগাণ্ডা ১৫ : এভারেস্ট জয়ের সুস্পষ্ট প্রমাণ কী? আমার উত্তর, একাধিক স্পষ্ট ছবি, যেখানে এভারেস্টের আশেপাশের ভৌগোলিক ফিচারগুলো বোঝা যায়; একটি ভিডিও লগ; সম্ভব হলে অন্যান্য পর্বতারোহীদের ডিসপ্যাচে উল্লেখ। এই তিনটির একটিও মুসা এখন পর্যন্ত জনসম্মুখে হাজির করেননি, কেবল একটি অস্পষ্ট ছবিকে এভারেস্টের শীর্ষে তোলা বলে প্রথম আলোতে প্রকাশ করা হয়েছে। এভারেস্ট অভিযানের ছবি যদি থেকেই থাকে, তাহলে সেসব প্রকাশ করা হচ্ছে না কেন?
অনুসন্ধান : এভারেস্ট জয়ের সুস্পষ্ট প্রমাণ হিসাবে একাধিক স্পষ্ট ছবি মুসা ইব্রাহীম ২০১০ সালের ২ জুন ঢাকার আইডিবি ভবনে এক সংবাদ সম্মেলনে সকল মিডিয়ার সাংবাদিকদের কাছে উপস্থাপন করেছেন। এছাড়া সামহোয়্যারইন ব্লগেই এসব ছবি ইতিপূর্বে প্রকাশ করেছেন একাধিক ব্লগার। এসব ছবি নিয়ে কারও কোনো সন্দেহ থাকলে গুগলে সার্চ দিয়ে অন্যান্য দেশের পর্বতারোহীদের এভারেস্ট জয়ের ছবিগুলো কেমন, সেটা দেখে নেওয়া যায় সহজেই।
জানা গেছে, শীঘ্রই মুসার সকল ছবি ও তথ্য নিয়ে একটি ওয়েবসাইট আসছে শীঘ্রই। আগামী নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে হতে যাচ্ছে প্রদর্শনী। তবে বলে রাখা ভালো, সামিটের যেসব ছবি আছে তা ইতিমধ্যে ব্লগ ও পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে, এর বাইরে সামিটের আর কোন ছবি নাই। মুসার বাকি ছবি যাত্রাপথ এবং ক্যাম্পের ছবি। প্রসঙ্গত, মন্টেনেগ্রোর পর্বতারোহী স্ল্যাগি এবং নেপালি পর্বতারোহী লাল বাহাদুর জিরেল যে মুসা ইব্রাহীমের সঙ্গে একই সময়ে এভারেস্ট চূড়ায় উঠেছেন, এর সত্যতা জানতে চেয়েছিলাম দুজনের কাছে পাঠানো পৃথক দুটি ইমেইলে। তারা দুজনেই সন্দেহাতীতভাবে এর সত্যতা স্বীকার করেছেন এবং একইসঙ্গে বিস্ময়ও প্রকাশ করেছেন এই ধরনের কৌতূহলে। তাদের ইমেইলের কপি দুটি আমার কাছে সংরক্ষিত রয়েছে। তবে এটা ঠিক যে, মুসা ইব্রাহীম তার কোনো ভিডিও সামিটে করেননি। করতে পারেননি। একই কথা সার্বিয়ান পর্বতারোহী ড্রাগুটিন, মন্টেনেগ্রোর পর্বতারোহী ব্লেকা, স্ল্যাগি ও জোকো এবং নেপালি পর্বতারোহী লাল বাহাদুরর জিরেলের ক্ষেত্রেও। তারাও কোনো ভিডিও করেননি। করতে পারেননি। ভিডিও না করলে যে এভারেস্ট জয় মিথ্যা হয়ে যায়- সৌরজগতে এমন দাবি এই প্রথম বাংলাদেশেই করা হচ্ছে জেনে গর্বিত বোধ করছি!

ঠাণ্ডায় ব্যাটারির কাণ্ড-অকাণ্ড
প্রপাগাণ্ডা ১৬ : অভিযানে মুসা ব্যাটারি ফুল চার্জ দিয়ে নিয়ে গেছিলেন কিন্তু ৭/৮টি ছবি তোলার পর ব্যাটারি শেষ হয়ে যায়। ব্যাপারটা অস্বাভাবিক নয় কি?
অনুসন্ধান : মুসা ইব্রাহীম এভারেস্ট চূড়ায় ১৯টি ছবি তুলেছিলেন- দু’য়েকটা বাদে সবগুলোই ফ্ল্যাশ দিয়ে। এভারেস্ট চূড়ার ভয়াবহ ঠাণ্ডার কথা ওয়াকিবহাল মাত্রেরই জানার কথা। বিশেষ করে ভোরবেলায় এভারেস্ট চূড়ার তাপমাত্রা সম্পর্কে গুগলের কল্যাণে ধারণা নেওয়া অতি সহজ। সেখানে ঠান্ডায় ব্যাটারির স্বাভাবিক অবস্থা থাকে না। কেউ কেউ বলছেন, একাধিক ব্যাটারি নিয়ে গেলে কী সমস্যা হতো? তাতেও বোধহয় কাজের কাজ কিছু হতো না। ঠান্ডার প্রভাব সকল ব্যাটারির উপরই পড়ে। আপনার যদি নৌকাডুবি হয় তাহলে আপনার সঙ্গে থাকা একটা ব্যাটারির যে অবস্থা হবে এক ডজন ব্যাটারিরও সেই একই অবস্থা হবে।

ছবি হিমালয়ের, তবে চূড়ার নয়
প্রপাগাণ্ডা ১৭ : ব্লগে প্রকাশিত এই ছবিগুলো হিমালয়ের যে কোনো জায়গায় হতে পারে। এগুলো তো আর চূড়ার ছবি নয়, নাকি?
অনুসন্ধান : ব্লগে প্রকাশিত ওই ছবিগুলো হিমালয়ের যেকোনো জায়গারই হতে পারে, বেশ তো বলুন তাহলে কোন্ জায়গার? সেই জায়গাটার পরিচয় খুঁজে বের করতে পারলেই বোঝা যাবে ছবিটি আসলে কোন্ জায়গার। গবেষণা করতে চাইলে এই ছবিটিতে দেখুন মুসা ‘ভি’ চিহ্ন দেখাচ্ছেন। সেই ছবিতে পেছনে হিমালয় রেঞ্জের বেশ কিছু চূড়া দেখা যাচ্ছে। ওই চূড়ার পরিচয় বের করলেই অনায়াসে বোঝা যাবে, এই এঙ্গেলে ওই চূড়ার ছবি কেবল এভারেস্ট টপ থেকেই নেওয়া সম্ভব।
এভারেস্টের পিছনে পিরামিড শ্যাডো দেখা যাচ্ছে যে ছবিটায়, সেটা যে মুসা ইব্রাহিমের তোলা, তা বিশেষায়িত যে কোনো সফটওয়্যার দিয়ে পরীক্ষা করলেই বোঝা সম্ভব। তাতে ক্যামেরার সিরিয়াল নম্বর এবং অন্যান্য তথ্য বের করা গেলে সহজেই পরীক্ষা করা সম্ভব সামিটের অন্যান্য ছবিগুলো একই ক্যামেরা দিয়ে একই লোকের হাতে তোলা কিনা।

মুসা ইব্রাহীমের সদ্য নেওয়া অডিও সাক্ষাৎকার
গ্রহণে : মাসকাওয়াথ আহসান
প্রথম পর্ব :


দ্বিতীয় পর্ব :


তৃতীয় পর্ব :


চতুর্থ পর্ব :


পঞ্চম পর্ব :


জিজ্ঞাসার দরজা খোলা
এরপরও যদি এই বিষয়ে ব্লগারদের কোনো জিজ্ঞাসা-প্রশ্ন থাকে, জানাতে দ্বিধা করবেন না। কোনো কোনো বিষয়ে অনুসন্ধানের খাতিরে জবাব দিতে কিঞ্চিৎ দেরি হতে পারে হয়তো, তবে কার্পণ্য থাকবে না। সামহোয়্যারের সদস্য নন যারা, তারা bolekoye[এট]gmail.com -এ মতামত-দ্বিমত জানাতে পারেন। সত্য উদঘাটনই এই অনুসন্ধানের মূল্য লক্ষ্য।

প্রথম প্রকাশ

Tags: , , , ,

About author

ফিউশন ফাইভ। ব্লগ লিখছেন পাঁচ বছরেরও বেশি সময় ধরে।

0 মন্তব্য

Leave a Reply