কৃষ্ণগহবরের কসম, পথের মানুষগুলোর দিকে একটিবার ফিরে তাকান, মাত্র একটিবার...

নিজের জন্য একটা সোয়েটার কিনতে যাচ্ছিলাম। পথে দেখলাম, ফুটপাতেই ভাসমান কিছু মানুষ মশারি টাঙিয়ে ঘুমোনোর আয়োজন করছেন। নারী-শিশু-বৃদ্ধও আছে সেই কাফেলায়। পাঁচ-ছয় বছর বয়স হবে বোধহয়, এক শিশুকে দেখলাম বড়োদের এক জীর্ণ কোট গায়ে জড়িয়ে বসে আছে ফুটপাতের এককোণে। আধো অন্ধকারে তার কাঁপুনি আমিও স্পষ্ট টের পাচ্ছিলাম। কি থেকে কী হয়ে গেল, নিজেই টের পেলাম না। শুধু মনে হল, বুকের কোনো একটা জায়গা খালি হয়ে গেল হঠাৎ! কম দামে কোথায় কাপড় পাওয়া যায়, সেটা জানা ছিল। বন্ধুকে নিয়ে পকেটে যা টাকা ছিল, সবটা দিয়ে প্রথমে শিশুদের কিছু সোয়েটার কিনলাম, তারপর বড়োদের জন্য আরো কয়েকটি। ইচ্ছে হল, আরো কিনি। কিন্তু ঘরে ফেরার টাকা ছাড়া আর কিছু ছিল না মানিব্যাগে। ঘন্টাখানেকের মধ্যে সেই জায়গায় ফিরে আসি বটে, কিন্তু লজ্জা আর কাটিয়ে উঠতে পারি না। শীতার্ত শিশু আর কয়েকজন বৃদ্ধের হাতে পোশাকগুলো তুলে দেয় আমার বন্ধুটি। তখনই জন্ম হয় আরেক দৃশ্যের। মুহূর্তের মধ্যে ভোজবাজির মতো প্রচুর মানুষ ছুটে আসে সেখানে। সবাই এক টুকরো কাপড় চান শীতের ছোবল থেকে বাঁচার জন্য। ভিক্ষা দেওয়ার বেলায় এমনিতে আমি চূড়ান্ত নির্মম। কিন্তু সামান্য দূরে দাঁড়িয়েও এইবার নিজেকে শ্রেফ একটা অসহায় মানুষ বলে মনে হচ্ছিল।

প্রতিরাতে অভাবী মানুষের যুদ্ধ
খোদ এই ঢাকায় কমলাপুর রেলস্টেশন, কারওয়ান বাজার, গুলিস্তানসহ বিভিন্ন ফুটপাত ও ওভারব্রিজে লাখ লাখ মানুষ শীতবস্ত্র ছাড়াই খোলা আকাশের নিচে রাত কাটাচ্ছে এখন। ঢাকার বাইরে অবস্থা আরো করুণ, আরো মর্মন্তুদ। দেশের অনেক জায়গায় সূর্যের মুখ দেখা যাচ্ছে না। তীব্র শীত সইতে না পেরে মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। দিনাজপুর, গাইবান্ধা, শ্রীমঙ্গলে ইতিমধ্যে কয়েকজনের মৃত্যু হয়েছে। আগামী কয়েক দিনে এই সংখ্যা আরো বাড়বে। যদিও মৃত্যুসংখ্যা দিয়ে এই শীতের তীব্রতা মাপা যায় না। শুধু বলতে পারি, এই কষ্টের ওপরে আর কষ্ট নেই। এর সঙ্গে আবার যুক্ত হয়েছে ক্ষুধার কষ্ট। সাধারণভাবে শীতের সময় ছিন্নমূল ও দরিদ্র মানুষের আয় কমে যায় সার্বিকভাবে। ফলে ক্ষুধা মেটানোই এখন দায় হয়ে পড়েছে অনেকের পক্ষে। আমার এক বন্ধু ফলোআপ করতে গিয়ে সেদিন দেখে অভাবী এক মানুষকে দেওয়া কম্বলটি পরদিনই তিনি ৫০ টাকায় আরেকজনের কাছে বিক্রি করে দিয়েছেন। ক্ষুধা যেখানে বড়ো, সেখানে এটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। ডাস্টবিন ঘেটেও হয়তো ক্ষুধা মেটানো যায়, কিন্তু শীত মানানো যায় না। কনকনে শীতের মধ্যেই এখন হু হু বাতাস আরেক উপদ্রব হয়ে উঠেছে। ফলে শীতের তীব্রতা বাড়ছে ক্রমেই। সুরম্য দালানের ভেতর বসে ইদানিং কাঁপছি রীতিমতো। অসহায় বিপন্ন মানুষের অবস্থা সহজেই অনুমান করা যায়। প্রতি সন্ধ্যায় হাঁটতে হাঁটতেই মানুষের প্রাণপণ সংগ্রাম দেখতে পাই। কিন্তু খড়কুটোতে আগুন জ্বালিয়ে কতোক্ষণ আর বসে থাকতে পারে ওরা? ছেঁড়া কাঁথা, চট কিংবা ছালা দিয়ে কতোটা আর শীত ঠেকাতে পারে তারা? আমার নিজের দেখায়, বৃদ্ধ আর শিশুরাই বেশি বিপন্ন হয়ে পড়ছে শীতে।

মানবতার অপমান!
দেশের দরিদ্র মানুষগুলো শীতের সঙ্গে প্রতি রাতেই এখন অসম যুদ্ধে লড়ে যাচ্ছে প্রাণপণ, শীতের ছোবল সইতে না পেরে তাদের অনেকে বরণ করে নিচ্ছে মৃত্যুকে, অথচ এই ঢাকাতেই বিলাসী জীবন যাপনে প্রতিদিনই ব্যয় হচ্ছে কোটি টাকা। প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরে একজনমাত্র সফরসঙ্গী কমালে সেই খরচে এক হাজার গরিব মানুষের গায়ে শীতের পোশাক তুলে দেওয়া যায়। সারা দেশে বিএনপির বাকি সম্মেলনগুলোর আয়োজনে যে খরচ হবে, তা থেকে সামান্য সাশ্রয় করলেও হাজার হাজার ছিন্নমূলকে শীতের অসহ্য কষ্ট পোহাতে হয় না প্রতিরাতে। এই শহরের বিত্তবানরা মাত্র একবেলা মদ না খেলে অন্তত একলাখ মানুষের একটা গতি হয়ে যায়। সংসদে একবেলা বেয়াই-বেয়াইনসুলভ অর্থহীন গল্পগুজব বাদ দিলে যে সাশ্রয় হয়, তা দিয়ে অন্তত ১০ হাজার মানুষের যন্ত্রণা লাঘব করা যায়। কিন্তু এই দেশের নাম বাংলাদেশ। এখানে কুকুরের চেয়েও অধম মানুষের জীবন। গুলশান-ধানমণ্ডি-বনানীতে পোষা কুকুরও শীতের পোশাক পায়, নিজের দেখা, কিন্তু দরিদ্র মানুষের সেই সৌভাগ্য হয় না।

একটিবার ফিরে তাকান
আপনি যখন এই লেখায় চোখ বুলোচ্ছেন, তখনও নিশ্চিত আপনার আশেপাশেই বহু মানুষ শীতের সঙ্গে অসহায় লড়ে যাচ্ছে। কৃষ্ণগহবরের কসম, পথের এই মানুষগুলোর দিকে একটিবার ফিরে তাকান, মাত্র একটিবার। কাল কিংবা পরশুর মধ্যেই। ওরা আমাদেরই লোক। আমার দেশের লোক। এদের কষ্টে রেখে আপনি ঘুমোতে পারেন না।

ছবির শিশুটির দেশের বাড়ি ময়মনসিংহের নান্দাইলে। মায়ের সঙ্গে থাকে মোহাম্মদপুরে বেড়িবাঁধে। ছবি সৌজন্য : প্রথম আলো

প্রথম প্রকাশ

Tags: ,

About author

ফিউশন ফাইভ। ব্লগ লিখছেন পাঁচ বছরেরও বেশি সময় ধরে।

0 মন্তব্য

Leave a Reply