হিমঘরে চাঞ্চল্যকর মামলা সংরক্ষণের কলাকৌশল

দেশের থানাগুলোতে প্রয়োজনীয় সংখ্যক হিমঘরের অভাবে মামলা সংরক্ষণ করা যাচ্ছে না। দেশে প্রতিদিন যে পরিমাণ মামলা হয়, সে পরিমাণ হিমঘর নেই, তদন্তকারী কর্মকর্তা তো দূরের কথা। এ কারণে প্রায়ই সরকারের ভাবমূর্তি সংকটের মধ্যে পড়ে। হাজার হাজার মামলা নিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে খেতে হয় হিমশিম। বস্তুত দেশের প্রতিটি থানায় হিমঘরের প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করার উপায় নেই। এর মাধ্যমে যেমন মামলাজট কমে আসবে, তেমনি পুলিশের হেফাজতে আসামির মৃত্যুর পর এদিক-সেদিক না ফেলে হিমঘরে রাখলে সংশ্লিষ্ট পুলিশ তথা সরকারি অর্থেরও সাশ্রয় হবে। মাত্র চারটি ধাপে যেকোনো চাঞ্চল্যকর মামলাকে অল্প পরিশ্রমে কীভাবে নিরাপদ হিমঘরে তুলে রাখা সম্ভব, তা নিয়ে এখানে রইল বিস্তারিত দিকনির্দেশনা—

 প্রথম ধাপ   

ঘটনার পর পর
সূচনাপর্বটুকু খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ঠিক এই সময়ে দরকার ধৈর্য ও বিশেষ সতর্কতা। এ জন্য সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা ছাড়া আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে হাতের কাছে নিম্নোক্ত উপকরণ রাখতে হবে: ১. কানের জন্য তুলা কিংবা রাবারের ছিপি, ২. চোখের জন্য কালো চশমা এবং ৩. নাকের জন্য সরিষার তেল। সম্ভব হলে আগাম প্রস্তুতি হিসেবে সংগ্রহ করে রাখা যেতে পারে এক বা একাধিক ‘জজ মিয়া’।
পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া: ঘটনার প্রতিবাদে সাধারণ ক্ষোভ, সংবাদ সম্মেলন, শোকসভা ইত্যাদি।
ব্যবস্থাপত্র: পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া উপরিউক্ত লক্ষণের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলে মামলার ভার থানা-পুলিশের হাতে রাখা যাবে। মামলা যেহেতু থানায়ই দায়ের হয়, সে জন্য থানা-পুলিশ ‘মোটিভ’ খুঁজে বের করা কিংবা হেসে-খেলে কাটানোর জন্য পাবে কমপক্ষে তিন মাস। ঊর্ধ্বতন মহল চাইলে এই সময় আরও বৃদ্ধি করতে পারবে। কেননা সময়ক্ষেপণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি ধাপ, তবে সাধারণ ক্ষোভের মাত্রা বেশি হলে কালবিলম্ব না করে মামলা হস্তান্তর করতে হবে ডিবির হাতে।
প্রথম ধাপের বাণীচিরন্তনী
ঘটনার সঙ্গে সঙ্গে—
● এটি নিছক বিচ্ছিন্ন ঘটনা। দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিঃসন্দেহে অতীতের তুলনায় অনেক ভালো। মানুষ এখন নির্ভয়ে চলাফেরা করতে পারছে।
● ২৪/৪৮/৭২ ঘণ্টার মধ্যে হত্যাকারী বা হামলাকারীদের ধরা হবে। এ লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট বাহিনীকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
ঘটনার ১৪ দিন পর—
● অনেক সময় বেঁধে দেওয়া সময়ের মধ্যে কাজ শেষ করা সম্ভব নয়। তবে তদন্তে প্রণিধানযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। কিন্তু তদন্তের স্বার্থে কিছু বলা যাচ্ছে না।
● ঘটনার কিছু আলামত পাওয়া গেছে।
ঘটনার এক মাস পর—
● খুনি/হামলাকারী চিহ্নিত করা হয়েছে। আসামিকে দ্রুততম সময়ে গ্রেপ্তার করা হবে।
ঘটনার তিন মাস পর—
● তদন্তের কাজ অনেক দূর এগিয়েছে, বেশ অগ্রগতিও হয়েছে। এ ঘটনায় যেকোনো মুহূর্তে দেশবাসী সুসংবাদ শুনতে পাবেন।

 নাট্যাংশের পাশাপাশি মহড়াও জরুরি
সচরাচর আমরা পুলিশের যুদ্ধংদেহী কঠিন রূপটিই দেখি। কিন্তু তাদের ভেতরেও আছে কোমল এক সৃজনশীল মন। এ ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব মুনশিয়ানা দেখিয়েছিলেন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর তাঁর ধ্রুপদি ‘জজ মিয়া’ শীর্ষক নাটিকায়। বস্তুত মামলায় গতি আনার লক্ষ্যে গল্প সাজানো কিংবা নাটক মঞ্চায়নের পালা অত্যাধুনিক অপরাধবিজ্ঞানের একটি অপরিহার্য বিষয় হয়ে উঠেছে। এ ক্ষেত্রে স্বাভাবিকভাবে তদন্তকারী কর্মকর্তারা নিজ নিজ প্রতিভা অনুসারে সৃজনশীলতা প্রদর্শন করবেন। সৃষ্টিশীল উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, চাঞ্চল্যকর ঘটনার সঙ্গে জড়িত সন্দেহে নাফ নদীতে চলাচলকারী কোনো নৌকার মাঝি কিংবা ঘটনাস্থল থেকে এক হাজার মাইল দূরের কোনো লেদমিস্ত্রি, ছুতার কিংবা ঝালমুড়ি বিক্রেতাকে গ্রেপ্তার করে স্বীকারোক্তি আদায় করা যেতে পারে। সবচেয়ে ভালো হয়, চালচুলোহীন বেকার কোনো যুবককে গ্রেপ্তার করা গেলে। তবে পূর্ব-সতর্কতা হিসেবে গ্রেপ্তারের সঙ্গে সঙ্গে পরীক্ষামূলকভাবে রি-অ্যাকশনও দেখতে হবে—পাবলিক কাকে কতটুকু খাচ্ছে। এ জন্য প্রতিটি নাটক মঞ্চায়নের আগে একাধিক মহড়ার আয়োজন করা জরুরি।


 দ্বিতীয় ধাপ    

ঘটনার তিন মাস পর
পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া: ঘটনার প্রতিবাদে মৌন মিছিল, মানববন্ধন, প্রতীকী অনশন, কর্মবিরতি, শোক র‌্যালি, মৌন মিছিল ইত্যাদি।
ব্যবস্থাপত্র: উপরিউক্ত পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মামলা হস্তান্তর করতে হবে গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) হাতে। কালক্ষেপণের জন্য তাদের হাতে থাকবে সর্বনিম্ন ছয় মাস।
দ্বিতীয় ধাপের বাণীচিরন্তনী
ঘটনার তিন মাস পর—
● ঘটনার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা নাগালের মধ্যে রয়েছে। যেকোনো সময় গ্রেপ্তার করা হবে।
ঘটনার চার মাস পর—
● ঘটনার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের ধরা পড়তেই হবে। জড়িত যে-ই হোক না কেন, কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। তাদের গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় আনা হবে।
ঘটনার পাঁচ মাস পর—
● আমরা ঘটনার ‘মোটিভ’ সম্পর্কে নিশ্চিত হয়েছি। এখন আপ্রাণ চেষ্টা করছি অপরাধীদের চিহ্নিত করতে। তদন্তের স্বার্থে সেই মোটিভ সম্পর্কে কিছু প্রকাশ করতে পারছি না।
ঘটনার ৬ থেকে ১২ মাস পর—
● ইতিমধ্যেই তদন্তে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে এবং অবশ্যই এ হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদ্ঘাটিত হবে।

 তৃতীয় ধাপ    

ঘটনার এক বছর পর
পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া: ঘটনার প্রতিবাদে বিক্ষোভ মিছিল, প্রতিবাদ সমাবেশ ইত্যাদি।
ব্যবস্থাপত্র: বর্ণিত পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার লক্ষণ সুস্পষ্ট হওয়ামাত্রই মামলাটি সিআইডির হাতে তুলে দিতে হবে। এটি নিয়ে অন্যূন তিন বছরাধিককাল সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা সময়ক্ষেপণের সুযোগ পাবেন।
তৃতীয় ধাপের বাণীচিরন্তনী
ঘটনার এক বছর পর—
● এই ঘটনার রহস্য উদ্ঘাটিত হবেই। আসামিদের চিহ্নিত করে পুলিশ আইনের মুখোমুখি করবে। তবে এ জন্য কিছুটা ধৈর্য ধরতে হবে।
ঘটনার দুই বছর পর—
● বিভিন্ন মাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্ত ও খুনের আলামত পর্যালোচনা করে দুই, তিন, চার, পাঁচ, ছয় বা সাতটি বিষয় মাথায় রেখে গোয়েন্দারা তদন্ত শুরু করেছে।
ঘটনার তিন বছর পর—
● তদন্ত সঠিকভাবেই চলছে। তবে ফল পেতে একটু সময় লাগবে।

 চতুর্থ ধাপ 

ঘটনার পাঁচ বছর পর
পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া: ঘটনার প্রতিবাদে কঠোর বৃহত্তর কর্মসূচি, ৪৮ ঘণ্টা ধর্মঘট, আমরণ অনশন ইত্যাদি।
ব্যবস্থাপত্র: অনতিবিলম্বে মামলা বদলি করতে হবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিশেষ মনিটরিং সেলে। সেখানে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সম্মতিক্রমে পাঁচ বছর থেকে অনির্দিষ্টকাল পর্যন্ত কালক্ষেপণ করা যাবে।
চতুর্থ ধাপের বাণীচিরন্তনী
ঘটনার পাঁচ বছর পর—
● ঘটনার রহস্য উদ্ঘাটনের লক্ষ্যে ইতিমধ্যে কয়েকটি দল একাধিক উপদলে বিভক্ত হয়ে দেশের বিভিন্ন জেলা ও উপজেলায় অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে। মামলার স্বার্থে এখনই কিছু জানাতে পারছি না।
● ঘটনার সঙ্গে জড়িত আসামিরা যাতে দেশ ছেড়ে যেতে না পারে, এ জন্য দেশের প্রতিটি বিমানবন্দর ও সীমান্তে সতর্কতা জারি করা হয়েছে।
ঘটনার ১০ বছর পর—
● আমরা অক্লান্তভাবে কাজ করে যাচ্ছি। হিমঘরে রক্ষিত মামলার কাগজপত্র ইঁদুরের কবল থেকে রক্ষা করার জন্য আমরা সত্যিই কাজ করে যাচ্ছি। আসামিরা ধরা পড়বেই।

 সংরক্ষণের জন্য চাই বাড়তি সতর্কতা

মামলার কাগজপত্র সংরক্ষণের জন্য বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত। তা না হলে মামলা নিয়ে অহেতুক চিন্তার উদ্ভব হতে পারে, যা তদন্তকারী কর্মকর্তার হূদেরাগেরও কারণ হয়ে উঠতে পারে। মামলার কাগজপত্র ও আলামত সংগ্রহের পর প্রথমে দেখতে হবে সেখানে কোনো রাজনৈতিক চর্বি লেগে আছে কি না। যদি সে রকম কিছু থাকে, তাহলে নিজ বিবেচনা দিয়ে সেটি পরিষ্কার করে নিতে হবে। পরে হালকা রোদে শুকিয়ে, সম্ভব হলে কিছুটা লবণ দিয়ে হিমঘরে সংরক্ষণ করতে হবে। ইঁদুর কিংবা কীটপতঙ্গের হাত থেকে মামলার কাগজপত্র রক্ষা করার জন্য পরিমাণমতো রাসায়নিক পদার্থ মিশিয়ে দেওয়া উত্তম।


প্রয়োজনীয় যত্নআত্তি
মানববন্ধন, অনশন কিংবা টেলিভিশনের টক শোতে নির্দিষ্ট কোনো মামলার প্রসঙ্গ উঠলে তদন্তকারী কর্মকর্তা অনধিক দুবার মামলার কাগজপত্র নাড়াচাড়া করে দেখবেন এবং গণমাধ্যমের সামনে সরকার-নির্ধারিত এক বা একাধিক মজুদকৃত ব্যবহারযোগ্য বাণী উচ্চারণ করবেন। সেই সঙ্গে হিমঘরে ইঁদুরের উপস্থিতির কোনো লক্ষণ দেখলে ঘটনাস্থলে ইঁদুর মারতে হবে। অধিক সতর্কতার জন্য স্তূপের নিচের কাগজপত্র ওপরে এবং ওপরের কাগজপত্র নিচে নেড়েচেড়ে দিতে হবে।


সংযুক্তি
ই-প্রথম আলো ১  □  ই-প্রথম আলো ২
প্রথম আলো অনলাইন সংস্করণ ১  □  প্রথম আলো অনলাইন সংস্করণ ২
ফেসবুক ফ্যান পেইজ ১  □  ফেসবুক ফ্যান পেইজ ২

প্রকাশকাল : ১৯ মার্চ ২০১২

Tags: ,

About author

ফিউশন ফাইভ। ব্লগ লিখছেন পাঁচ বছরেরও বেশি সময় ধরে।

0 মন্তব্য

Leave a Reply