কৃষ্ণগহবরের কসম, এই বাংলাদেশের সামনে শুধুই অন্ধকার!

আমি কোডিং জানি না। কিন্তু রেন্ট-এ-কোডার আর ওডেস্কে বহুকষ্টে গড়া একটি পোর্টফোলিও আছে আমার। বিশুদ্ধ কোডিং না জেনেও সেখানে কাজ মেলে। শুরুতে এমনকি বিনামূল্যেও কাজ দিতো না কেউ। রেফার করার মতোও ছিল না কেউ। কিন্তু পড়ে ছিলাম মাটি কামড়ে। উত্তেজনা ছিল, লোভও ছিল। প্রকাশ্য নিলামে অংশ নিয়ে জলের মূল্যে কাজ নিতে শুরু করি একটি-দুটি করে। ২০০ ডলার মূল্যের কাজ এমনকি ৫০ ডলারেও। চার মাসেরও বেশি সময় পর তাতে লাভ হয়েছিল এটাই যে, মোটামুটি একটি পোর্টফোলিও তৈরি হয়ে গিয়েছিল। তাতে কাজ পাওয়া হয়ে গিয়েছিল তুলনামূলক সহজ। কিন্তু যতোই সময় যায়, বড়ো কাজে হাত দিতে আতঙ্কগ্রস্থ হয়ে উঠি। চাকরি থেকে ঘরে ফিরে বিদ্যুৎ পাই না। সন্ধ্যা থেকে গভীর রাত পর্যন্ত অন্ধকারে বসে প্রতীক্ষায় থাকি- ঘড়ির কাঁটা কখন তিনের ঘরে আসবে। তখন একটু বিদ্যুৎ মেলে ঠিকই, কিন্তু সময়ে-অসময়ে বিগড়ে যায় ইন্টারনেট। এ যেন বিদ্যুতেরই আরেক সহোদরা। গ্রামীণফোনের পিছনে প্রতি মাসে হাজার হাজার টাকা ঢেলেছি, এখন আর তাদের মধুমাখা বাণী সহ্য হয় না। তারও আগে ছিল ফ্রডব্যান্ড নিয়ে নিত্যদিনের দুশ্চিন্তা। সাবমেরিন ক্যাবল গেছে আমার পাশ দিয়ে। আমি অধম নাগরিক ১০ কিলোবাইট গতি নিয়ে ভারতীয়-ফিলিপিনো যুবকের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতার স্বপ্ন দেখে যাই। কিন্তু অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, গত প্রায় একমাস ধরে ছোট-বড়ো আর কোনো নিলামেই অংশ নিই না। কোনো কাজই আর নিচ্ছি না। ইচ্ছেটাই মরে যাচ্ছে। বিদ্যুতের সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে এখন মাঝপথেই হাল ছেড়ে দেই - ঘুমিয়ে পড়ি। এরপরও আমি একদিক থেকে সুখী। কারণ আমি কৃষক নই, আমাকে মাঝরাতে বিদ্যুতের আশায় ফসলের ক্ষেতে বসে থাকতে হচ্ছে না। আমি শিল্পমালিক নই, বিদ্যুতের অভাবে মেশিনের চাকা ঘুরছে কি ঘুরছে না তা নিয়ে আমার মাথাব্যথা নেই।

সন্ধ্যা নামলেই পাড়ার মোড়ে মোড়ে জেনারেটরের আকাশকাঁপানো চিৎকার বলে দেয়, কী দুর্ভোগের দিনরাত আমরা পার করছি। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা আকবর আলী খান বলেছেন, গণতন্ত্রের চেয়েও বিদ্যুৎ জরুরি। আমি বলি, বিদ্যুতের কাছে আর সবকিছুই তুচ্ছাতিতুচ্ছ। প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় কিংবা দুর্যোগেও আসলে দেশের সবাই ক্ষতিগ্রস্থ হয় না, কিন্তু বিদ্যুৎহীনতায় দেশের প্রতিটি মানুষ ক্ষতিগ্রস্থ হয় এবং বর্তমান পরিস্থিতিতে সেটাই হচ্ছে। ছোট থেকে বড়ো ব্যবসায়ী, শিক্ষার্থী থেকে চাকরিজীবী, গৃহিণী থেকে মুটে-মজুর- সবারই পিঠ এখন দেয়ালে ঠেকে গেছে। এতো আশা-প্রত্যাশা নিয়ে যে মানুষ আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়ে ক্ষমতায় বসিয়েছে, সেই মানুষই এখন হতাশ, ক্ষুব্ধ। অথচ সরকারের কাছে কোনো সমাধানই যেন নেই। তাদের এমনকি কোনো প্রস্তুতিও নেই। কয়েকদিন আগেও চীন মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রে ২০-৩০ লাখ টাকা ব্যয়ে মুজিবনগর দিবসের অনুষ্ঠান করা হয়েছে। যে দেশের দুই-তৃতীয়াংশ লোক খেতে পায় না, সেখানে এইসব বিলাসী দিবস পালন না করলে কী হয়?

টাকার জন্য বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যাচ্ছে না- তাও নয়। টাকার অভাব তো অন্তত এই সরকারের নেই। রাজস্ব বোর্ড সময়ে-অসময়ে কুত্তাপাগল হয়ে মানুষের ঘরে ঘরে হানা দিয়ে ভ্যাট আর কর হাতিয়ে নিচ্ছে। যোগাযোগমন্ত্রী যখন সেই অর্থে নিজের জন্য কোটি টাকা মূল্যের গাড়ি পছন্দ করেন, তখন অন্তত বুঝতে অসুবিধা হয় না, বাংলাদেশে টাকার অভাব খুব বেশি নেই। যদি টাকার অভাব থাকেও, উপজেলা চেয়ারম্যান আর মন্ত্রীদের জন্য কোটি কোটি টাকা খরচ করে পাজেরোর বহর কিভাবে কেনা হচ্ছে? মন্ত্রীর দফতর সাজাতে কিভাবে এক-দেড় কোটি টাকা ব্যয় করা হচ্ছে? রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান আর প্রতিমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক যে বিদেশে গেলেন চিকিৎসা নিতে, তাতে কি কমপক্ষে অর্ধকোটি টাকা ব্যয় হয়নি রাষ্ট্রের? সুতরাং টাকার অভাব বোধকরি তেমন নয়, বরং অভাবটা হল সৎ ইচ্ছার। সরকারের সৎ ইচ্ছা নেই বলে, সরকার অতীতচারণায় ব্যস্ত বলে, সরকার মানুষকে মানুষ গণ্য করে না বলেই বিদ্যুৎ নিয়ে সামনে কোনোই সুসংবাদ নেই। আমার তো মনে হয়, বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধান আসলে কখনোই হবে না। আগামী চার-পাঁচ বছর পর যদি নতুন কিছু বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালুও করা হয়, তাতেও কিছুই হবে না। সেই পাঁচ বছরে বাংলাদেশে আরো মানুষ বাড়বে, চাহিদাও বাড়বে।

কৃষ্ণগহবরের কসম, এই বাংলাদেশের সামনে অন্ধকার ছাড়া আর কিছুই দেখতে পাই না। সূর্যটা ডুবে গেলে এই বাংলাদেশ এক অন্ধকার গ্রহ ছাড়া আর কিছুই নয়। আমাদের যা কিছু ঋণ, তা ওই সূর্যের কাছেই!

লেখাটির বিষয়বস্তু(ট্যাগ/কি-ওয়ার্ড): শেখ হাসিনাআওয়ামী লীগলোডশেডিংবিদ্যুৎawami leaguesheikh hasinaload shedding ;

প্রথম প্রকাশ

Tags: ,

About author

ফিউশন ফাইভ। ব্লগ লিখছেন পাঁচ বছরেরও বেশি সময় ধরে।

0 মন্তব্য

Leave a Reply