সংবাদপত্রের প্রবণতা নিয়ে কামাল লোহানীর অসাধারণ লেখা

কদিন আগে দৈনিক আমাদের সময় পুরো প্রথম ও শেষ পৃষ্ঠা বিজ্ঞাপনে ভরিয়ে দিয়েছিল। প্রবীণ সংবাদিক কামাল লোহানী একে বলেছেন "পাঠকের সঙ্গে প্রতারণা"। এ বিষয়েই তার দীর্ঘ একটি লেখা, তবে সুপাঠ্য। আমি নিশ্চিত, অনেকের মধ্যেই ভাবনার খোরাক যোগাবে লেখাটি।

----------------------------------------------------------------
পরিবর্তন মানে যা ইচ্ছে তাই নয়
কামাল লোহানী
----------------------------------------------------------------
‘আত্মসমর্পণ না সাংবাদিকতার অবমাননা’ প্রতিক্রিয়াটি আপনাকে পাঠানোর দীর্ঘদিন পরও যখন দেখলাম ছাপা হচ্ছে না, তখন বুঝলাম আপনি ওটা ছাপবেন না। কিন্তু' ৯ মে দেখলাম ছেপেছেন কিন্ত' পাশেই ‘আমরা টিকে থাকার সংগ্রাম করছি’ শিরোনামে আপনি জবাব দিয়েছেন। বুঝলাম ছাপাটা বিলম্বিত হয়েছে, জবাবটা তৈরির জন্য। তবু ছেপেছেন এ জন্য অবশ্যই আপনাকে ধন্যবাদ জানাব। আপনার তো অকপটে অপরাধ স্বীকারের দৃষ্টান্ত ছাপার অক্ষরেই পড়েছি। তবে সে অপরাধ ১ পেয়েছি, ২ চোখে পড়েনি। যাকগে সেসব। আদত কথায় আসি, প্রথমে অনুরোধ আমার এই লেখাটি বিলম্ব না করে যদি ছাপেন তবে বেহদ খুশিই হবো। কারণ সময় পেরিয়ে গেলে প্রাসঙ্গিকতা ভুলে বসেন পাঠক।

এটা ঠিক, আমার অভিজ্ঞতার শুরু যখন, তখন একটি দৈনিক প্রকাশে কোটি কোটি টাকা লাগতো না। হাজার হাজার হলেই চলত। কারণ তখন ছাপা ব্যয় কম ছিল, সাংবাদিক বা কর্মচারী সকলেরই বেতন এখন ভাবতেও পারবেন না, এত কম ছিল। তখন একাউন্স থেকে চার আনা নিলে খাতায় অ্যাডভান্স হিসেবে লেখা হতো। বেতন ছিল শুরুতে ৭৫ টাকা। কিন্তু' সম্পাদকীয় ইনস্টিটিউশনটা ছিল মর্যাদাসম্পন্ন। সম্পাদক হতেন শ্রদ্ধার পাত্র, যোগ্যতা এবং অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ। তাকে ব্যবস্থাপনা দেখতে হতো না। ওটা দেখতেন ম্যানেজার, জেনারেল ম্যানেজার, ম্যানেজিং এডিটর। তা সত্ত্বেও বেতন বকেয়া পড়ত না, এমন নয়। যেমন, তিন-চার মাস বেতন না পেলে ধর্মঘটও হতো। এমনকি প্রকাশিত কাগজের সম্পাদকীয় নিবন্ধের মধ্যে ‘দস্যু মোহন তিনমাস বেতন দেননি’ বলে একটি ক্রোধের লাইনও ঢুকে গেছে। তার জন্য সাসপেন্ডও হয়েছেন ক’জন কম্পোজিটর। মর্মান্তিক ছিল নাকি তখনকার সময়টা? তখন অ্যাপয়েনমেন্ট লেটারও ছিল না। মুখে মুখেই সব ঠিক করা হতো। তারপরও কিš' লেবার কোর্টে অভিযোগ করলে অনেক ক্ষেত্রেই ফল মিলতো পজিটিভ। তখন সম্পাদক ছিলেন আব্দুস সালাম, তফাজ্জল হোসেন, জহুর হোসেন চৌধুরী, আবুল কালাম শামসুদ্দিন প্রমুখ। এমনকি মানিক মিয়া সম্পাদক-মালিক হয়েও ব্যবস্থাপনা দেখভাল করতেন না। তার জন্যে সেকালের খ্যাতিমান শ্রমিক-নেতা আব্দুল কাদের এবং পরে প্রাক্তন ছাত্রনেতা এস এ ওয়াদুদ ছিলেন। অবজারভার পত্রিকার ব্যবস্থাপনা দেখতেন কবি আব্দুল গণি হাজারী যিনি ম্যানেজিং এডিটর ছিলেন। তার স্থলাভিষিক্ত হয়েছেন জাঁদরেল রেল শ্রমিক নেতা এবং জাতীয় সংসদের সদস্য মাহবুবুল হক। দৈনিক সংবাদে ছিলেন মাহবুবুর রহমান খান জেনারেল ম্যানেজার। মালিক হয়েও সম্পাদকই ছিলেন জহুর হোসেন চৌধুৃরী। দৈনিক আজাদে জেনারেল ম্যানেজার ছিলেন মওলানা আকরাম খাঁর পুত্র খলিলুর রহমান।

এসব পত্রিকা সচ্ছল ছিল কি? ওদের কি সংগ্রাম কম করতে হয়েছে? কে সময় মতো বেতন দিতে পারতেন ইত্তেফাক-অবজারভার ছাড়া? কার না বকেয়া পড়ত? তখন তো বিজ্ঞাপনের জন্য করাচি-পিন্ডি ছোটাছুটি করতে হতো। কিš' এরও মধ্যে দৈনিক আজাদ-এ অ্যাপ্রেন্টিস হিসেবে কর্মরত একজন রিপোর্টারকে বিদায় করতে গিয়ে সাংবাদিক ইউনিয়নের হস্তক্ষেপে পুরো সময়ের বেতন কর্তৃপক্ষকে দিতে হয়েছিল। তিনি অত্যন্ত খ্যাতিমান সাংবাদিক। আজকের মতো অর্থ-সংকটের অজুহাতে পার পাওয়া সম্ভব ছিল না। ছাঁটাই তো দূরের কথা। তখন তো ফয়েজ আহমদের মতন এডিটর অত্যন্ত ‘এই সংবাদ ছাপা কেন হলো’ তার অভিযোগে রিপোর্টারকে পদচ্যুত করতেন না। বরং নিজেই সম্পাদক ঐ অভিযোগ মেনে নিয়ে পদত্যাগ করার সাহস দেখাতে পারতেন। অথচ হোসেন তওফিক চৌধুরীকে চাকরি হারাতে হয়েছিল পূর্বদেশ থেকে কারণ তার সম্পাদক রিপোর্টারের উপর আনা অভিযোগ নিজের কাঁধে নিতে রাজি হননি। ভূরি ভূরি এমন উদাহরণ দিতে পারি। সালাম ভাই রাষ্ট্রভাষার জন্য, মানিক ভাই আইয়ুবের সামরিক শাসনে জেলে গেছেন এবং জহুর ভাই বিএনপি আমলে। এই সব এডিটরের তবে কি বোধশক্তির অভাব ছিল? এরা কেউ ব্যবস্থাপক ছিলেন না।

সে আমলের চেয়ে বর্তমানে মুদ্রণ প্রযুক্তিতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন চোখের সামনে দেখেছি। ব্যবস্থাপনাও পাল্টেছে। আর আপনারা সম্পাদক হয়ে ব্যবস্থাপকও হয়েছেন। আগের কালে কখনোই কোনো সম্পাদক বিজ্ঞাপনের জন্য ব্যবহৃত হতেন না। কাগজে কান্নাকাটি করা তো দূরের কথা! আপনারা তাও করতেন। পুরনোদের বোধ ছিল সংবাদের জন্যে, আর এখন আপনাদের কাকুতি-মিনতি বিজ্ঞাপনের জন্য। তখনকার দিনে কিন্তু সম্পাদকরা সামান্য নয়, বরং বিপুল বোধশক্তির অধিকারী ছিলেন। তাই অশালীন, কুৎসিত, বিকৃত বাংলার কোনো বিজ্ঞাপনই ছাপাতেন না। নিউজ এডিটর কিংবা রাতের শিফট-ইন-চার্জ হিসেবেও সংবাদ ধরানোর জন্য বিজ্ঞাপন পর্যন্ত বাদ বা পরের দিনের জন্য রেখে দেয়ার অঢেল দৃষ্টান্ত আমাদের আছে? তবে কি বলবেন, ওঁদের বোধশক্তি সম্পর্কে আপনি সন্দিহান?

আপনার ‘বোধসম্পন্ন’ লেখা পড়ে বিজ্ঞাপনে মাস্টহেড ব্যবহার করার অপরাধটাকে যেভাবে প্রমাণ করতে যুক্তি দেখিয়েছেন, তা কি সংবাদপত্র প্রকাশনার মৌলিক নৈতিকতাবিরোধী মনে হচ্ছে না? আপনি বলেছেন, মাস্টহেড বিজ্ঞাপনেরই অংশ। এ কি করে হয়? আমরা তো মূর্খ এবং স্বশিক্ষিত, সেখানে আপনি তো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শুনেছি কৃতী ছাত্র। পুঁথিগত বিদ্যা কি এটাই শিখিয়েছে? আমার বিশ্বাস, জবাব নেতিবাচকই হবে। আপনি বলেছেন, পাঠক আপনাদের এই ‘অপকর্ম’ মেনে নিয়েছেন অস্তিত্বের স্বার্থে। পাঠকের দোহাই দিচ্ছেন কেন, ওঁরা তো নীতিমালা জানেন না, যা আপনি পড়ে শিখেছেন। অযথা ধর্মগ্রন্থ টেনেছেন কেন? সংবাদপত্র তো ‘রিজিড’ কিছু নয়। পরিবর্তন হতেই পারে, হয়েছেও। মেশিনে, মুদ্রণে, অক্ষরে, প্রকৃতিতে, চরিত্রের অনেক পরিবর্তন হয়েছে সময়ের বিবর্তনে। তাই বলে কি যা খুশি তাই করেছে কেউ, যা আপনি করছেন? পরিবর্তন অর্থ যা ইচ্ছে তাই করা নয়, মৌল ভিতের ওপরেই করতে হয়। নতুনধারা প্রবর্তনে প্রথমদিকে যা করেছিলেন, তা কিন্তু দারুণ প্রশংসিত হয়েছিল। তখন অধীত বিদ্যাগত প্রথানুযায়ীই কিন্তু করেছিলেন। এখন যা করছেন, তাতে নৈতিকতা বলে কিছু থাকছে না। আপনি মানুষের বদ্ধমূল ধারণা থেকে বের করতে চান। কিš' এক ঢাকা থেকেই যে অগুনতি দৈনিক বের হচ্ছে তার কোনো পরিবর্তন কি করতে পেরেছেন? মজার ব্যাপার হলো, যে পরিবর্তন এনে নতুন করে সাজিয়েছিলেন, তা কিন্তু নিজেও ধরে রাখতে পারেননি। পরিবর্তন কি জোর করে চাপানো যায়? প্রয়োজনে স্বাভাবিকভাবেই পরিবর্তন এসে যায়।

একবার বলুন তো, এই যে ১১ তারিখের কাগজটির চেহারা বানিয়েছেন, একে কি সংবাদপত্রের নৈতিকতা-মাফিক বলতে পারি? একটি দৈনিকের প্রথম পাতা সাদা রেখে ভেতরের পাতায় খবর দেখতে বলেছেন, আর কিছুই নেই তাতে। অথচ দু’রঙের মাস্টহেড ঠিকই আছে। আবার এর জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছেন। প্রথম পূর্ণ পাতায় লেখা ‘আজকের শীর্ষ খবর শেষের পাতায়’ কিন্তু' শেষ পৃষ্ঠা অর্থাৎ ৮ নং পাতায় ‘ওয়ারিদ’ এর পাতাজুড়ে বিজ্ঞাপন। পাঠককে কেন এভাবে ‘প্রতারণা’ করেছেন? সেকি ‘সংগ্রাম’ করছেন বলে যে কান্নাকাটি মাঝেমাঝেই করতে দেখি, এও কি তাই? ঐ ফাঁকা পাতাটার মূল্য তো অন্য পাতার চারগুণ।

দেশে সংবাদপত্র পরিষদ, এডিটরস কাউন্সিল নেই। সাংবাদিক ইউনিয়ন দ্বিখণ্ডিত এবং নিষ্ক্রীয়, এমতাবস্থায় যা করছেন, তার বিরোধিতা করার কেউ নেই। থাকলে এমন করতে পারতেন না। পাঠক সচেতন হয়েও কি করবেন? আপনার যে যোগসাজশ তাতে আদালতের শরণাপন্ন হয়েও কোনো ফল মিলবে না। দেশের হাইকোর্টকেই মূল্য দেয় না সুপ্রিম কোর্ট, তো প্রতিকার কি হবে?
যা করছেন, এসব কোন কেতাবে লেখা আছে? কোন বিশ্ববিদ্যালয় পাঠ দিয়েছে? অনুগ্রহ করে এসব বন্ধ করুন। বডিটাইপ আর কত ছোট করবেন, সেটাও জানতে ইচ্ছে করে।

সম্পাদক মহোদয়, একটা কথা বলে শেষ করি, তা হলো যোগসাজশ সব সময়ই ছিল, তবু মাত্রা বজায় রেখে চলতেন, যারা এর উপাসক ছিলেন। কিন্তু আজকাল এর মাত্রাও মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। সেটা ছাড়াও আপনার একার যে নতুনত্ব পরিবর্তনের দাবি, তাকে কি রস সাহিত্যের সেই ‘নতুন কিছু কররে ভাই, নতুন কিছু কর’ ডাকে শুনেছেন আপনি? তাতে কবি বলছেন, আর কিছু না পারো তবে মাথা নিচে দিয়ে হাঁটতে তুমি পার। তাও যদি না পারো তবে বৌকে পেটাতে পারো। কী চমৎকার সমাধান কিংবা পরামর্শ, তাই না। আপনিও তাই করতে চাইছেন সংবাদপত্র শিল্পে, না কি? সর্বশেষে প্রথম পৃষ্ঠা খবর-শূন্য রেখে যা দেখালেন, তা কি ‘বস্ত্রহীন’ হরফে বাসনারই প্রকাশ আর সেকি বর্তমানের মনুষ্য চরিত্রসম্মত?

প্রথম প্রকাশ : ১৮ জুন ২০০৮

Tags:

About author

ফিউশন ফাইভ। ব্লগ লিখছেন পাঁচ বছরেরও বেশি সময় ধরে।

0 মন্তব্য

Leave a Reply