ব্লগ প্রতিযোগিতা : ভোট নিয়ে অবিশ্বাস্য জালিয়াতি, বিশ্বাসযোগ্য তদন্ত চাই

মনোনয়ন নিয়ে কিছু পর্যবেক্ষণ

■ বাংলাব্লগে গত একবছরে উল্লেখযোগ্য সামাজিক আন্দোলন বলে কিছু যদি হয়ে থাকে, সেটা ইভটিজিং বিরোধী আন্দোলন। কিন্তু ভাবমূর্তি বৃদ্ধিকরণ প্রকল্পের আওতায় 'ভাইপো' রেজওয়ানের চোখ পড়েছে অমি রহমান পিয়ালের ওপর, গত একবছরে যিনি ব্লগ থেকেই উধাওপ্রায়। যদি দু বছর আগে পিয়ালকে মনোনীত করা হতো, তাহলে বুঝতাম যোগ্য লোককেই তারা মনোনীত করেছেন। যদিও বাংলাব্লগে গালাগালি আর অশালীনতা আমদানির প্রধান হোতাদের অন্যতম তিনি। আর দু বছর আগের হিসাবই যদি গণনাযোগ্য হবে, তাহলে উইকিপিডিয়ার রাগিব কেন অচ্ছ্যুৎ? কেন বছর বছর তাহলে ব্লগ প্রতিযোগিতার আয়োজন?
■ আরিফ জেবতিকের ব্লগে গিয়ে দেখলাম, গত এক বছরে তার সর্বমোট পোস্ট ১০-১২টির মতো, যার অর্ধেকই বইমেলা নিয়ে হাবিজাবি। আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পোস্ট সম্ভবত এটি। পাঁচ বছর আগের এক ভ্যালেরি টেইলর নিয়ে ইমেইল চালাচালি বেচে একজন ব্লগারকে কতো আর ওপরে তোলা যায়!‍
■ ব্যক্তি আক্রমণ যার ব্লগিংয়ের প্রধান সম্বল, বাংলা ব্লগমণ্ডলে এ যাবতকালের সবচেয়ে বড়ো মিথ্যাচার ও কেলেঙ্কারির জন্ম দেওয়া সদা পোঁদকাতর সেই হিমুও সেরা ব্লগারের তালিকায় আসতে পারে?
■ বিডিনিউজ ব্লগে আইরিন সুলতানার যে ব্লগ সেটার বয়স একমাস মাত্র। ৩০ দিন ব্লগিং করেও বর্ষসেরার তালিকায় ঢোকা সম্ভব? এর চেয়ে বরং আইরিনের সামহোয়্যারের ব্লগটি অনেক সমৃদ্ধ। তবে এরপরও ভোট দিলে সম্ভবত তাকেই দেব, কারণ আইরিন প্রকৃতই একজন ব্লগার।
■ শহীদলিপি নামের একটি কি-বোর্ড লেআউটের নির্মাতা ব্লগার হিসেবে কেন অনন্য, তার পুরো ব্লগ ঘেঁটেও বুঝলাম না। এটাও বিচারক রেজওয়ানের কোটাবাজির নিকৃষ্ট উদাহরণ।
■ সেরা ব্লগ হিসেবে মনোনয়ন পাওয়া ব্লগস্পট-ওয়ার্ডপ্রেসভিত্তিক ব্লগগুলো নিতান্তই গরিবি ব্লগ, এরকম একেকটা ব্লগ জন্ম থেকে মন্তব্য পেয়েছে হয়তো বড়জোর ১০টি। আর তাতে বোঝা যায় পাঠকই নেই ব্লগগুলোর। এবং পুরোটাই ফাজলামি!
■ শুনেছি, 'ভাবমূর্তি মোটাতাজাকরণ প্রকল্পের' আওতায় প্রার্থী আরো ছিলেন অনেকেই। এই সূত্রে মান-অভিমানের ঘটনাও নাকি ঘটেছে আড়ালে। একদিকে সুশান্তের উপর্যুপরি চাপ, অন্যদিকে সচলায়তনের জন্য মিনিমাম তিনটি আসন রাখা জরুরি, আবার ৮০ ভাগ ব্লগারের জায়গা সামহোয়্যারের একেবারে কাউকে না রাখলে খারাপ দেখাচ্ছে। সবমিলিয়ে এক রেজওয়ানের পক্ষে কতোজনের মন আর রক্ষা করা সম্ভব, কতো চাপ আর সামলানো সম্ভব! আরিফ জেবতিক-হিমু-পিয়ালকে একই ক্যাটাগরিতে রাখা দৃষ্টিকটু লাগে বলে বিচারক বেচারা পিয়ালকে সরিয়েছেন সোশ্যাল অ্যাকটিভিজম ক্যাম্পেইন ক্যাটাগরিতে।
■ মজার কাণ্ডটা ঘটেছে রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার ক্যাটাগরিতে। সেখানে মনোনয়ন পেয়েছে জনৈক আবু সুফিয়ানের ব্লগ। ইনি বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে ছাপা হওয়া তার ৬-৭টি রিপোর্টের ব্যাকআপ রেখেছিলেন ব্লগস্পটের মাগনা জায়গায়। পড়ে মনে হল, রিপোর্ট নয়, থানায় জমা পড়া কোনো খুনের মামলার এজাহার পড়ছি। রেজওয়ান আবার সেটাকে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার শ্রেষ্ঠ নিদর্শন হিসেবে ধরে একেবারে রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার ক্যাটাগরিতে ঢুকিয়ে দিয়েছেন। এই যদি হয় অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার নমুনা, তাহলে আমাদের কোম্পানিগঞ্জের মজনু আর সাইফুল্যাহ কামরুলের কমপক্ষে ১০বার রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার পুরস্কার পাওয়া উচিত!

ভোট নিয়ে নজিরবিহীন কাণ্ড
২৪ ঘন্টা পর পর একই ব্যক্তি একাধিক ভোট দিতে পারবেন- আমি এটাকে বাগই মনে করেছি শুরুতে। কিন্তু পরে দেখলাম ডয়েচে ভেলে কর্তৃপক্ষ
ঢোল বাজিয়ে অফিসিয়ালিই এই জাল ভোটের জন্য সবাইকে অনুপ্রাণিত করছে। শুনছি ফেসবুক-টুইটারে বাণ্ডেল হিসেবে একাউন্ট খোলা হচ্ছে, দিনে দুবার সেগুলো থেকে জালভোট চলছে। তার চেয়েও উদ্বেগজনক তথ্য হচ্ছে, একটি ব্লগের কর্তৃপক্ষীয় উদ্যোগে বিশেষ বিশেষ প্রার্থীর পক্ষে সংঘবদ্ধভাবে ভোট দেওয়া হচ্ছে। সাধারণ নির্বাচনে কারচুপি যেমন লক্ষণ দেখে বোঝা যায়, অনলাইন ভোটেও সেরকম লক্ষণ দেখে জালিয়াতির বিষয়গুলো বুঝে নেওয়া যায় সহজেই। লক্ষ্য করার বিষয় হচ্ছে প্রায় পাঠকবিহীন আমারব্লগের ব্লগাররাই বিভিন্ন বিভাগে শীর্ষে অবস্থান করছে। এটা রীতিমতো অলৌকিক ঘটনা। যেমন ধরা যাক, আরিফ জেবতিক গত অন্তত দু বছরে ব্লগে তেমন একটা সক্রিয় নন, সামান্য যা কিছু লিখেন, তাও তুলনামূলক পাঠকবিহীন একটি ব্লগে। তাহলে তার এতো ভোট আসছে কোত্থেকে? প্রতিদিনই দেখছি, গায়েবী ভোট পড়ছে তো পড়ছেই। খুব তীক্ষ্ম চোখে লক্ষ্য করেছি, ভোট গ্রহণের প্রথম দিন থেকেই একটি বিশেষ প্যাটার্নে আরিফ জেবতিক, অমি রহমান পিয়াল এবং সাবরিনার ব্লগটিতে ভোট দেওয়া হচ্ছে - কম নয়, বেশিও নয়, প্রতিদিনই প্রায় একটি নির্দিষ্ট হারে। এই কারসাজি ঢাকতে একইসঙ্গে অস্বাভাবিক হারে ভোট দেওয়া হচ্ছে আবু সুফিয়ান এবং পাবর্ত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক ব্লগসহ আরো দু একটিতে। প্রতিবন্ধী ব্লগার সাবরিনার জন্য খারাপ লাগে, বেচারী কিছু অসৎ লোকের পাল্লায় পড়ে গেছেন।

মেশিনের পাকা কাজ
প্রতিযোগিতার বিভিন্ন বিভাগে শীর্ষস্থানে থাকা ব্লগ ও প্রাপ্ত ভোটের (শতকরা হারে) প্যাটার্নটা একবার মিলিয়ে দেখুন। মেশিনের পাকা কাজ, কোনোরূপ নড়চড় চলিবে না!
আরিফ জেবতিকের ব্লগ - ৪১% ভোট
আদিবাসী বাংলা ব্লগ - ৪১% ভোট
সাবরিনা’র ব্লগ - ৪০% ভোট
আবু সুফিয়ান’এর ব্লগ - ৪০% ভোট
অমিপিয়াল’এর ব্লগ - ৩৮% ভোট
ওদিকে অভ্রের নির্মাতা মেহদী হাসান খানের ব্লগের লিংক সচলায়তনের বলে বেচারা আমারব্লগের অটো ভোটিং মেশিনের সহায়তা পাচ্ছে না দুঃখজনকভাবে। তার প্রাপ্ত ভোট ৩৪% মাত্র। অথচ মেহদীর সর্বদলীয় একটি গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে, ভালো ভোটই তার পাওয়ার কথা। এদিকে সামহোয়্যারের ব্লগারদের সর্বাত্মক প্রচেষ্টা সত্ত্বেও ইমন জুবায়েরের ব্লগে ভোটের হার ক্রমেই কমছে। আজকে একধাপ নেমে এখন ১৯%-এ এসে পৌঁছেছে।

অথচ ফেসবুক জরিপেই করুণ দশা
দু-তিনদিন আগে ফেসবুকে এক ব্লগারের পরিচালিত একটি জরিপ খুঁজে পেলাম। আমারব্লগের ভোটিং মেশিন চালু হওয়ার আগেই এক হিমু (৪৬ ভোট) ছাড়া বিখ্যাত ব্লগারদের করুণ হাল দেখে নিন একনজর- আরিফ জেবতিক : ১৫ ভোট, অমি রহমান পিয়াল : ৯ ভোট, ইমন জুবায়ের : ১১ ভোট, শওকত হোসেন মাসুম : ৪ ভোট, আলী মাহমেদ : ২ ভোট, রেজওয়ান : ১ ভোট।

জালিয়াতির সবগুলো পথ খোলা
হিসেব করে দেখেছি, একটি ফেসবুক কিংবা টুইটার একাউন্ট থেকে সবমিলিয়ে ৮৪টি ভোট দেওয়া যাবে ডয়েচে ভেলের নিয়ম অনুসারে। টুইটার-ফেসবুকে মাত্র ১০০টি একাউন্ট (এটা খোলার মতো সহজ কাজ দুনিয়ায় আর কিছু নেই) খুললে সাড়ে আট হাজার ভোট দেওয়া যাবে অটোমেটেড সফটওয়্যার কিংবা স্ক্রিপ্ট ছাড়াই। একজন ধূর্ত প্রার্থীর পক্ষে ১০০টি ফেসবুক ও টুইটার একাউন্ট বানিয়ে দিনে দুবার লগইন করে নিজেই নিজেকে ভোট দেওয়া জলবৎ তরলং ব্যাপার। ভাবছেন এতোগুলো ফেসবুক-টুইটার একাউন্ট খোলা কি সহজ কথা? হ্যাঁ, সহজই
স্ক্রিপ্ট চালিয়ে হাজারে হাজারে ভোট দেওয়া এমন কোনো জটিল কাজ নয়। ফেসবুকে যেমন নয়, তেমনি কঠিন নয় গণহারে জিমেইল একাউন্ট কিংবা শত শত ফেসবুক একাউন্ট তৈরি করা। চলমান প্রতিযোগিতায় ভোট জালিয়াতির এক অবিশ্বাস্য কাহিনী উঠে এসেছে ব্লগার তর্পণের অসাধারণ অনুসন্ধানে। পড়ুন প্রথম পর্বদ্বিতীয় পর্ব

এবার তুলনা দেই একটু
বেস্ট সোশ্যাল অ্যাকটিভিজম ক্যাম্পেইন বিভাগে অমি রহমান পিয়াল ৩৭% ভোট নিয়ে শীর্ষে। ২৭% ভোট নিয়ে দ্বিতীয় স্থানে আছে একটি স্প্যানিশ ব্লগ। রুশ ব্লগ তৃতীয়। স্প্যানিশভাষী ইন্টারনেট ইউজারের যে ভয়াবহ সংখ্যা, তার ০.১ ভাগও যদি ব্লগ প্রতিযোগিতায় ভোট দিতে আসে, তাহলে বাংলা ব্লগ তলানিতে গিয়ে পড়ার কথা। শুধুমাত্র স্পেনেই ব্লগারের সংখ্যা কমপক্ষে তিন মিলিয়ন। আর যে দেশে মোট জনসংখ্যার ৪২ ভাগই ইন্টারনেট ব্যবহার করে, সেই রাশিয়ার অতি ক্ষুদ্র অংশও যদি তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করে, দুনিয়ার সমস্ত বাংলাভাষী ইন্টারনেট ইউজার তাদের সর্বশক্তি ব্যয় করেও পেরে ওঠার কথা নয়। যেমনটি দেখা গেছে সপ্তাশ্চর্য নির্বাচনের ক্ষেত্রে। পুরো বাংলাদেশ প্রাণান্ত চেষ্টা করেও কক্সবাজারকে মূল তালিকাতেই তুলতে পারেনি, সুন্দরবন এখনো ধুঁকছে তালিকার নিম্নভাগে। তাহলে ঘাপলাটা কোথায়? অন্য দেশের ব্লগারদের কি আগ্রহ নেই এই প্রতিযোগিতা নিয়ে, নাকি বাংলাদেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারী বেড়ে গেছে অলৌকিক উপায়ে?
আবার দেখুন হিউম্যান রাইটস ক্যাটাগরিতে সন্তু লারমার পার্বত্য জনসংহতি সমিতির আনঅফিসিয়াল ব্লগ ৪৭% ভোট পেয়ে শীর্ষে। দ্বিতীয় স্থানে আছে একটি পর্তুগিজ ব্লগ, ১৯% ভোট নিয়ে। অথচ পর্তুগালে ইন্টারনেট ইউজারের
অবস্থা দেখুন।ওদিকে সেরা ব্লগ বিভাগে ৪০% ভোট নিয়ে সাবরিনার ব্লগ শীর্ষে আছে, ২২% ভোট নিয়ে দ্বিতীয় স্থানে আছে একটি অ্যারাবিক ব্লগ। আরবীভাষীদের অবস্থাও দেখুন একনজর। বিপরীতে বাংলাদেশের ইন্টারনেট পরিস্থিতি দেখুন, ব্লগারের হিসাব আশা করি না নিলেও চলবে। সুতরাং সেই একই প্রশ্ন আবারও- এতো ভোট আসছে কোত্থেকে? আকাশের ওপর থেকে নয় তো?

ভোট জালিয়াতির বিশ্বাসযোগ্য তদন্ত চাই দ্রুত
ডয়চে ভেলের চলমান প্রতিযোগিতায় ভোট জালিয়াতির ঘটনা যে ঘটছে, এ নিয়ে এখন কারোরই সন্দেহ নেই। হাস্যকর হয়ে ওঠা এই প্রতিযোগিতা বয়কটের আহ্বানও জানাচ্ছেন অনেক ব্লগার। আমরা চাই, ডয়চে ভেলে কর্তৃপক্ষ ভোট জালিয়াতির ঘটনা অবিলম্বে তদন্ত করে দেখবে। যেসব ব্লগে অবিশ্বাস্য ভোট পড়েছে, সেগুলোকে আলাদাভাবে চিহ্নিত করে প্রাপ্ত ভোটগুলোর প্যাটার্ন ও অন্যান্য আলামত শনাক্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। দ্রুত এই তদন্ত শেষ করে মনোনয়নপ্রাপ্ত প্রতারক ব্লগারদের চিহ্নিত করা হলে ডয়চে ভেলের ভাবমূর্তিই বাড়বে।

সংযুক্তি
ইমন জুবায়েরের জন্য ভোট চেয়ে স্টিকি পোস্ট, ববস্‌ বেস্ট ব্লগার...
আসমানী ভোটে বিজয়ীতব্য ব্লগশ্রেষ্ঠ, ব্লগউত্তম, ব্লগপ্রতীকদের অগ্রীম শুভেচ্ছা


প্রথম প্রকাশ

Tags: ,

About author

ফিউশন ফাইভ। ব্লগ লিখছেন পাঁচ বছরেরও বেশি সময় ধরে।

0 মন্তব্য

Leave a Reply