শীতসন্ধ্যায় পল্টন থানায় এক বিরল প্রতিভার মুখোমুখি

অফিস থেকে বেরুবো বেরুবো ভাবছি। তখনই আমার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধুর ফোন। পল্টন থানায় তার কী যেন কাজ। সঙ্গে যাওয়ার কাতর অনুরোধ করেই ক্ষান্ত নয় বন্ধু, আধঘন্টার মাথায় গাড়িসমেত এসে হাজির, আমার অফিসের নিচে। অগত্যা যেতেই হল। থানা, সেটা যেখানেই অবস্থিত হোক না কেন, যাওয়াটা খুব সুখকর কাজ নয়। এমনিতে অনিয়মিত পর্যটক হয়েও বলে দিতে পারি, ঢাকার থানাগুলোর চেহারা খানিকটা বদলেছে, তবে খুব নজর কাড়ার মতো নয়। প্রত্যাশিত শ্রী খুঁজে পেলাম না যথারীতি পল্টনেও। যাওয়া ঢাকার ব্লগার মাত্রেই জানেন, রাজধানীর সবচেয়ে অপরাধপ্রবণ থানাগুলোর মধ্যে শীর্ষে আছে এই পল্টন থানা।

বন্ধুর উদ্দেশ্য তার পুরনো মামলা হলেও আমার কৌতূহল ছিল অন্যত্র। এর আগে শুনেছিলাম, ঢাকার ৪০টি থানায় পুলিশের কাজ পর্যবেক্ষণের জন্য ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা বসানো হচ্ছে। ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, কর্তব্যরত কর্মকতাসহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তার কক্ষ তো বটেই, এমনকি থানায় ঢোকার পথেও সেই ক্যামেরা বসানোর সিদ্ধান্ত হয়েছিল বলে জানি। কথা ছিল, থানাগুলো থেকে ধারণ করা চিত্র ডিএমপি কমিশনার স্বয়ং দেখবেন। কিন্তু আস্ত ক্যামেরা-ট্যামেরা দূরের কথা, পল্টন থানায় সেরকম কিছুর লক্ষণই খুঁজে পেলাম না। শুনেছি, এর আগে দুয়েকটি থানায় ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা স্থাপন করা হলেও কিছুদিনের মধ্যেই সেগুলোতে নাকি অনিবার্যভাবে 'যান্ত্রিক ত্রুটি' দেখা দিয়েছে। এ দিকটা ভেবে ক্যামেরা সংক্রান্ত যাবতীয় জিজ্ঞাসা মনেই চাপা দিয়ে রাখলাম। কাউকে জিজ্ঞেস করে লজ্জা দিতে বা নিজে লজ্জা পেতেও ইচ্ছে হল না খুব একটা।

ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা নাকি বিস্তর ব্যস্ত। দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। সেই ব্যস্ততার তোড়ে তার সহকারী নেইমকার্ড নিয়ে যেতে পর্যন্ত রাজি হল না। অগত্যা থানার ভেতরে একজন উপ-পরিদর্শকের সঙ্গে আলাপ জমানোর চেষ্টা চলল। আলাপ বলা ঠিক হবে না, মারেফতি লাইনের 'এই দেশের কী হবে গো' গোছের আর্তি কিংবা আর্তনাদই মিনিটদশেক ধরে অনুরণিত হল। এই করে করে যখন বিরক্তির প্রায় শেষ সীমায়, তখনই আশার প্রদীপ যেন দপ করে জ্বলে উঠল। টেবিলের ওপাশে হাতকড়া পরা এক লোক। হাত তুলে থানার সেই উপ-পরিদর্শক বৃত্তান্ত পেশ করলেন গর্বিত ভঙ্গিতে। এক লাখ টাকার চেক ঘষেমেজে এক কোটি টাকা করার মামলা!

ঘটনা তিন বছর আগের। কামাল আতাতুর্ক এভিনিউর একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে কাজের বিল বাবদ ১ লাখ টাকার একটি চেক নেন ছাপাখানা ব্যবসায়ী মাইনুদ্দিন আহমেদ। কর্মক্ষেত্র ছাপাখানা হলেও প্রতিভায় তিনি অসামান্য। সামান্য ঘষেমেজে দুটি শূন্য বাড়িয়ে ১ লাখ টাকার চেকটিকে তিনি মাত্র ১ কোটি টাকায় রূপান্তর করেন। তবে বেচারার দুর্ভাগ্য। চেকটি ব্যাংকে জমা দিতে গেলে ব্যাংক কর্মকর্তারা সন্দেহ করে বসেন। প্রতিভার চ্ছটা দেখিয়ে ব্যাংক থেকে তিনি বেরিয়ে আসেন বটে, তবে মামলা থেকে বেরুনোর সৌভাগ্য তার হয়নি। গত সোমবার পল্টন থানার পুলিশ অবশেষে তাকে প্রগতি সরণী থেকে গ্রেপ্তার করে।

দেহের ঘাম শুকানোর আগেই যেমন মজুরী প্রদান আবশ্যক, তেমনি এই ধরনের বিরল প্রতিভাকে তৎক্ষণাৎ স্বীকৃতি দেওয়াও প্রায় ফরজের অন্তর্ভুক্ত। বাংলাদেশের রন্ধ্রে রন্ধ্রে আসলেই প্রতিভার ছড়াছড়ি। বাব্বাহ্!


প্রথম প্রকাশ

Tags: ,

About author

ফিউশন ফাইভ। ব্লগ লিখছেন পাঁচ বছরেরও বেশি সময় ধরে।

0 মন্তব্য

Leave a Reply