
বাংলাদেশের স্থলভাগে ক্রমেই ফুরিয়ে আসছে জ্বালানির মজুদ। গ্যাস প্রায় নিঃশেষ। ঢিমেতালের অনুসন্ধানে নতুন কোনো সুসংবাদও নেই। তেল আর কোথায়! কয়লায় এখন পর্যন্ত সবেধন নীলমনি ওই বড়পুকুরিয়া। এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের জন্য শেষ ভরসা হিসেবে আছে একমাত্র বঙ্গোপসাগর। বাংলাদেশকে ঘিরে আছে দুটি মাত্র দেশ- মিয়ানমার ও ভারত। বঙ্গোপসাগরে তাদেরও ভাগ আছে। এই জায়গায় বাংলাদেশের সঙ্গে দেশ দুটির পার্থক্য হচ্ছে, তেল-গ্যাসের খোঁজে তারা বঙ্গোপসাগর চষে বেড়াচ্ছে আর অন্যদিকে টিভি চ্যানেলের মাউথপিস মুখে নিয়ে বাংলাদেশ রাজা-উজির মেরে বেড়াচ্ছে।
গায়ে পড়ে ঝগড়া যে কারণে হয়
বঙ্গোপসাগরে অধিকার নিয়ে ভারত ও মিয়ানমারের মনোভাব এখন পর্যন্ত গায়ে পড়ে ঝগড়া লাগানোর মনোভাব। জেনেশুনেই তারা আন্তর্জাতিক আইনকে অবজ্ঞা করছে। তবে প্রতিটি দেশই নিজেদের স্বার্থ দেখবে, তা যেভাবেই হোক না কেন- সেটিই স্বাভাবিক। বাংলাদেশকেও তার নিজের স্বার্থটি দেখতে হবে। শুধু দেখলেই হবে না, অগ্রাধিকারভিত্তিতে দেখতে হবে।
এমনিতে সামরিক শক্তি যতোই থাক, যে অর্থনৈতিক অবস্থা আমাদের, তাতে কারো সঙ্গেই সংঘাতে যাওয়ার সঙ্গতি নেই বাংলাদেশের। বিকল্প থাকে একটিই- কূটনৈতিক উদ্যোগ। কিন্তু এই যে মিয়ানমার সেন্টমার্টিনের দিকে বাংলাদেশ সীমানায় ঢোকার সাহস পেল, ভারত যে মংলার দিকে ঢুকে বসে আছে- এ সবই ইতিপূর্বেকার সরকারগুলোর মূর্খতার ফল, এ সবই তো অমার্জনীয় কূটনৈতিক ব্যর্থতার ফল।
দুই প্রতিবেশীর দিনকাল

বঙ্গোপসাগরে মূষিকপ্রসব
রাজনৈতিক সরকারগুলোর লুটপাট আর দীর্ঘ শীতনিদ্রা শেষে এই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উদ্যোগে গত ফেব্রুয়ারিতে বঙ্গোপসাগরের গভীরে ২০টি এবং অগভীর সমুদ্রে আটটি ব্লক নির্ধারণ করা গেছে। সেখানে অনুসন্ধান কাজ চালানোর জন্য আন্তর্জাতিক দরপত্রও আহ্বান করা হয়। সংক্ষেপে একে বলা যেতে পারে 'পর্বতের মূষিকপ্রসব'। তবে দৌড়ে অনেক পিছিয়ে থাকার পরও যে বাংলাদেশ উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে- এটা আবার হয়ে গেছে ভারতের মাথাব্যাথা, তা বোঝা যায় আজ শনিবার ভারতীয় হাইকমিশনার পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তীর প্রশ্নে- "যখন আলোচনা চলছে, তখন বাংলাদেশ সরকার কেন ওই এলাকায় খনিজ অনুসন্ধানে আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করলো?" ইতিপূর্বে বাংলাদেশ ব্লকগুলো ঘোষণার পরই ভারত আটটি ব্লকের ব্যাপারে এবং মিয়ানমার ঢালাওভাবে আপত্তি জানিয়েছে। মিয়ানমার যেসব এলাকায় গত বছর সাত টিসিএফ গ্যাসের খোঁজ পেয়েছে, ওই এলাকাগুলো বাংলাদেশ সীমানার খুব কাছেই। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তা বাংলাদেশের সমুদ্রসীমানার মধ্যেই পড়েছে। বাংলাদেশ সীমায় ঢুকতে তাদের মরিয়া হয়ে ওঠার কারণও এ থেকে বোঝা যায়।
ভেতরবাড়ির সমস্যা
জ্বালানি সম্পদ নিয়ে মাতামাতি শুরু হওয়ার পর বিএনপি নেতৃত্বাধীন সরকারই ক্ষমতায় ছিল বেশি সময়। কিছুকাল ছিল আওয়ামী লীগও । তারা একযোগে তেল ও গ্যাস ক্ষেত্রের ইজারা নিয়ে ক্ষমাহীন দুর্নীতি ও অনিয়ম করেছে। সিলেটের দিকে তাকান, সাঙ্গুর দিকে তাকান- দেখবেন অমূল্য জ্বালানি সম্পদ নিয়ে এই রাজনৈতিক টাউটগুলো কী লুটপাট, দুর্নীতি ও অনিয়ম করেছে! বিশেষ করে বিএনপি নেতৃত্বাধীন সরকারগুলো দেশের অপূরণীয় ক্ষতি করেছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এই ক্ষতি সাদা চোখে এখনই দেখা যাচ্ছে না হয়তো, তবে এই ক্ষতির বোঝা নিশ্চিতভাবেই বিশাল এবং দীর্ঘস্থায়ী। ভেতরবাড়িতে এই ধরনের সমস্যা আবার ভারত ও মিয়ানমারের নেই। থাকলেও তা মূল কাজে প্রভাব ফেলে না। দেশের স্বার্থ তাদের কাছে সবার আগে।
বরং বাংলাদেশ এগিয়ে যাক নিজের মতো
একটি পথই এখন খোলা- সমুদ্রসীমার দাবি বাংলাদেশকে তুলে ধরতে হবে জোরালোভাবে। তার জন্য নিবিড় হোমওয়ার্কের দরকার আছে। দেশের অভিজ্ঞ জ্বালানি বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নিয়ে চালাতে হবে জোর কূটনৈতিক তৎপরতা। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র দপ্তরে পেশাদার মেধাবী কূটনীতিকের অভাব প্রচণ্ড। দিনে দিনে এটা হয়ে উঠেছে বয়স্ক পুনর্বাসন কেন্দ্রে। ভারতের রাজিব সিক্রির (একসময়কার ভারতীয় হাইকমিশনার বীনা সিক্রির স্বামী) মতো মেধাবী কূটনীতিবিদ বাংলাদেশের পররাষ্ট্র দপ্তরে কেউ আছেন কি? নেতাদের তৈলমর্দনে তারা যতোটা সিদ্ধহস্ত, দেশের জন্য তার সামান্যও না। গণমাধ্যমের ওপরও খুব বেশি আস্থা রেখে লাভ নেই। আমাদের সময় সম্পাদক নাঈমুল ইসলাম খান তেল-গ্যাস কম্পানির গণসংযোগ বিভাগের দায়িত্ব পালন করছেন। তথাকথিত এনার্জি রিপোর্টারদের জীবনের লক্ষ্যও একটিই- বিদেশী বেনিয়াগুলোর পয়সায় বিদেশ ভ্রমণ। অপাত্রে আশা করে লাভ নেই সুতরাং! বরং বাংলাদেশ এগিয়ে যাক নিজের মতো, নিজের বিবেচনা সম্বল করে।