অভিনন্দন! তবে বিজয়ের তোড়ে যেন প্রতিপক্ষের কণ্ঠ হারিয়ে না যায়


সত্তুরের নির্বাচনের কথা স্মরণ করে প্রবীণ অনেকে নস্টালজিক হবেন নিশ্চিত, তবে গত শনিবারের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিশ্চিতভাবেই ইতিপূর্বেকার সবগুলো নির্বাচনকে ম্লান করে দিয়েছে। এমন শান্তিপূর্ণ পরিবেশ, এমন স্বচ্ছ পদ্ধতি আর জনতার এমন স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ইতিপূর্বে আর দেখা যায়নি। এই প্রথমবারের মতো মোট ভোটারের ৮০ শতাংশ তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছেন। কোথাও কোথাও এই হার ৯০ শতাংশেরও বেশি। কোনো সন্দেহ নেই, নির্বাচনে দেশের সিংহভাগ মানুষের রায় পেয়েছে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট। ভূমিধস বিজয়ে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট পেয়েছে ২৬২টি আসন, বিএনপি নেতৃত্বাধীন চার দলীয় জোট পেয়েছে ৩২টি আসন। মহাজোটের এই নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন নিঃসন্দেহে আনন্দের খবর, তবে খুব বেশি নয়।

নিরঙ্কুশের সমূহ শঙ্কা
এমনিতে ভূমিধস বিজয় কিংবা নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা কখনোই ঠিক পছন্দ করার মতো নয়। এতে প্রথমত ভারসাম্যটা নষ্ট হয়ে যায়। অতীতে এ ধরনের নিরঙ্কুশ বিজয়ের অভিজ্ঞতাও আমাদের ভালো নয়। ১৯৯৬ সালের সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে আওয়ামী লীগ যখন ক্ষমতায় গিয়েছিল, তখনকার অভিজ্ঞতা সুখকর নয় মোটেও। মানুষ এর জবাব দিয়েছে ২০০১ সালের অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট ক্ষমতায় এনে। সেবারও এবারের মতো ধসনামানো বিজয় পেয়ে, নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে একনায়ক হয়ে ওঠা বিএনপি-জামায়াতের স্বৈরতান্ত্রিক-ঘিনঘিনে মৌলবাদী চেহারাটা দেখার দুর্ভাগ্য হয়েছিল আমাদের। দিনে দিনে চলা সেই স্বৈরতন্ত্র জন্ম দিয়েছিল একপাল আপাদমস্তক লোভী মানুষের। গত দু বছরে আমরা তাদের নির্লজ্জ মুখ দেখেছি কখনো প্রিজনভ্যানে, কখনো আদালতের বারান্দায়, কখনোবা কারাফটকে ফুলের মালা গলায়।
ফলে, সবমিলিয়ে, মহাজোটের এই ভূমিধস বিজয় সচেতন নাগরিক এবং শিক্ষিত শ্রেণীর অনেককেও কিছুটা শঙ্কায় ফেলে দিয়েছে নিশ্চিত। এই শঙ্কা দলের প্রতি বিদ্বিষ্ট হয়ে নয়, বরং প্রকৃত ভালোবাসার প্রকাশ।

শক্তিশালী বিরোধী দল যে কারণে জরুরি
এই মুহূর্তে একটি বিষয় স্পষ্ট হয়ে গেছে, আগামী সংসদে শক্তিশালী কোনো বিরোধী দল থাকছে না। এই নির্বাচনে বিএনপির যা প্রাপ্তি, তাতে তাদের সম্মিলিত চিৎকারও সংসদ স্পিকারের চেয়ার পর্যন্ত পৌঁছাবে কিনা সন্দেহ। জাতীয় পার্টি তার স্বভাবমতোই 'এই বসন্ত এই হেমন্ত' নীতিতে এগোবে। এমনকি তাদের গৃহপালিত বিরোধী দলের ভূমিকায়ও হয়তো দেখা যেতে পারে। তাতে আর যাই হোক, শক্তিশালী বিরোধী দলের অভাবটা পূরণ হয় না। তবে এমন নয় যে, বিএনপি আরো কটি আসন পেলে, আরো একটু ভালোভাবে জিততে পারলে তারা বেশ দায়িত্বশীল আচরণ করতো। বরং বিএনপির মধ্যে এই একটি গুণেরই অভাব বেশি। তারপরও শক্ত একটি বিরোধী দলের উপস্থিতি জরুরি এই কারণে যে, নিরঙ্কুশ বিজয় পাওয়া কোনো দল একনায়ক হয়ে ওঠার সুযোগ সহজে পায় না। বিরোধী দলের চাপটা থাকলে শাসকদলের একনায়কসুলভ আচরণ সহজে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠার সুযোগ পায় না।

সম্মুখে দুটি পথ
নিরঙ্কুশ এই অর্জনের পর আওয়ামী লীগের সামনে দুটি পথ খোলা। প্রথমত তারা দিনে দিনে একনায়কের শাসন প্রতিষ্ঠা করবে। দ্বিতীয়ত বাংলাদেশের ইতিহাসে পরমতসহিষ্ণু আদর্শ সরকারের দৃষ্টান্ত তৈরি করতে পারে তারা।
আওয়ামী লীগ নেতা মোহাম্মদ নাসিমের কথা মনে থাকবে অনেকেরই। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী থাকাকালে তিনি দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির নজির সৃষ্টি করেছিলেন, প্রতিপক্ষকে দমন করেছিলেন নারকীয় কায়দায়। পরের নির্বাচনে বিএনপি ক্ষমতায় যাওয়ার পর ঢাকার রাজপথে পুলিশের লাঠির আঘাতে নাসিমের রক্তমাখা জামা আমরা দেখেছি। প্রতিশোধ সবসময়ই প্রতিশোধের জন্ম দেয়। বরাবর অসহিষ্ণুতার যে চিত্রটি আমরা দেখি, সেটি বদলানোর সুযোগ আওয়ামী লীগের সামনে আছে। প্রতিপক্ষের সঙ্গে প্রতিশোধপরায়ণ অসংযত আচরণ নয়। বেদনাময় ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি যেন আর না হয়। ভিন্নমতাবলম্বী প্রতিবেশী যেন কুণ্ঠা বোধ না করেন। বিজয় উদযাপনের তোড়ে আর নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে যেন প্রতিপক্ষের কণ্ঠ হারিয়ে না যায়। আপনি বলুন, তাকেও বলতে দিন। 

Tags: ,

About author

ফিউশন ফাইভ। ব্লগ লিখছেন পাঁচ বছরেরও বেশি সময় ধরে।

0 মন্তব্য

Leave a Reply