জীবন যাক দু একটা, তবু রুখে দিন নামকরণের জন্য মরিয়া এই ম্যানিয়াকদের


স্কুলে ভাষণ দিতে গিয়ে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী গতকালও সেই একই শিবের গীত গাইলেন এই বলে- 'একটি কুচক্রী মহল বঙ্গবন্ধুর নামে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর নির্মাণের পরিকল্পনাকে বাধাগ্রস্ত করতে মিথ্যা ও বিভ্রান্তিমূলক তথ্য ও গুজব ছড়িয়ে সাধারণ মানুষকে আন্দোলনের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। রাজনৈতিক ফায়দা লুটতে ও মহাজোট সরকারের ধারাবাহিক উন্নয়ন থামিয়ে দিতে অপচেষ্টা চালানো হচ্ছে।'

সেই একই রেকর্ড...
শুনে আসছি গত দু বছর ধরে। সরকার, বলা ভালো আওয়ামী লীগের বিপক্ষে কেউ অবস্থান নিলেই 'যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচাল করতেই' কিংবা 'ধারাবাহিক উন্নয়ন থামিয়ে দিতেই এই অপচেষ্টা' বলে হুঙ্কার ছাড়েন সরকারের প্রধান থেকে মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীরাও। প্রতিমন্ত্রীর দেখছি অতো সাহস নেই। আড়িয়ল বিলের দিকে যেতে পারছেন না। উস্কানিমূলক বক্তব্য-টক্তব্য দিয়ে ঘুরে আসছেন আশেপাশের এলাকা থেকে। তার আগেই আড়িয়ল বিলে মানুষের পিঠ ঠেকে গেছে দেয়ালে। নারীরা ঝাড়ু নিয়ে তৈরি, তরুণদের মাথায় কাফনের কাপড় আর হাতে লাঠি, এমনকি যে বৃদ্ধার চলার শক্তিও নেই তিনিও দা হাতে পাহারা দিচ্ছেন নিজেদের ভূমিটুকু। এদের কারোরই রাজনৈতিক পরিচয় নেই, বেশিরভাগই নির্দলীয়। এই লোকগুলোর সামনে দাঁড়ানোর সাহস নেই সরকারের। তারা পারছে শুধু নিরীহ মানুষগুলোর ওপর পুলিশ লেলিয়ে দিতে, নিরীহ মানুষগুলোকে মামলার পর মামলা দিয়ে হয়রানি করতে। সবমিলিয়ে সরকারের অবস্থান জনতার বিপক্ষে, জনমতের বিরুদ্ধে। আচরণ পুরো মাফিয়ার মতো।

অথচ ভালো যুক্তি নেই একটিও
দেখবেন, বিমানবন্দর স্থাপনের পক্ষে সরকারের হাতে ভালো যুক্তিও নেই। বিমানসচিব যুক্তি দেখিয়েছেন, ঢাকায় যেহেতু একটিমাত্র রানওয়ে, ফলে কোনো বিমান দুর্ঘটনায় পড়লে ভবিষ্যতে সমস্যা হবে। আর 'সমস্যা' হবে বলে ঢাকা বিমানবন্দরের পাশেই দ্বিতীয় আরেকটি রানওয়ে নির্মাণের উদ্যোগ না নিয়ে ২৫ হাজার একর ভূমি নষ্ট করে ১০ লাখ মানুষকে কর্মহীন করে দিয়ে আরেকটি বিমানবন্দর বানাতে হবে, তাও ৫০ হাজার কোটি টাকা ব্যয় করে? এমন তো নয় যে, ঢাকা বিমানবন্দরের পাশে জায়গা নেই। জায়গা যথেষ্টই আছে, নইলে পাশের ১৩০ একর জমি শ্রেফ লুটেপুটে খাওয়ার জন্য কিভাবে তুলে দেওয়া হল নামসর্বস্ব এক প্রতিষ্ঠানের কাছে? আর রানওয়ের অজুহাত যদি জীবিত রাখাও হয়, তাহলে উদাহরণ হিসেবে জানানো যায়, জাপানের নারিতা বিমানবন্দরেও রানওয়ে একটি। নারিতার তুলনায় ঢাকা বিমানবন্দর নিতান্তই মফস্বলস্থানীয়। ফলে বোঝা যায়, এটা কোনো ভালো কাজ নয়, বরং জনগণের অর্থের অপব্যবহার। এদিকে আমরা দেখছি, বিমানবন্দরই শুধু নয় নিরীহ কৃষককে আরো বিপদে ফেলে বিশাল 'বঙ্গবন্ধু সিটি' করারও উদ্যোগ আছে সরকারের।

যেখানে মানুষের চেয়ে পরিবার বড়ো
আড়িয়ল বিলে বিমানবন্দর স্থাপনের এই সিদ্ধান্ত পুরোপুরি প্রধানমন্ত্রীর শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত ও পারিবারিক একটি ইচ্ছা - তাতে কোনোই সন্দেহ নেই। শুধু পিতার স্মৃতি ধরে রাখার জন্য শেখ হাসিনা ও তার সরকার কয়েক শত বছরের ঐতিহ্যবাহী জলাশয় ও আড়িয়ল বিলকে বিপন্ন করতে চাইছে। বঙ্গবন্ধু বিমানবন্দর আর বঙ্গবন্ধু সিটি যদি বাস্তবায়িত হয়েই যায়, হাজার হাজার মানুষ যে নিজেদের ভূমি থেকে উচ্ছেদের শিকার হবে তা শুধু নয়, ঢাকা ও মুন্সিগঞ্জ জেলার তিন উপজেলায় বিস্তৃত মধ্যাঞ্চলের সবচেয়ে বড় জলাধারটির প্রায় পুরোটা শেষ হয়ে যাবে। ঢাকার আশপাশে বন্যার প্রকোপও আরো বাড়বে। সরকার সেসব নিয়ে ভাবছে না।
শীতটা কেটে গেলেই আবার নামবে ভ্যাপসা গরম। বাড়বে বিদ্যুতের চাহিদা। উৎপাদন যেহেতু মোট চাহিদার ভগ্নাংশের সমপরিমাণ, সুতরাং জনজীবনে শীঘ্রই নেমে আসবে সেই পুরনো হাহাকার। সরকারের নজর সেদিকে নেই। বিদ্যুতের টাওয়ারের নাম তো আর বঙ্গবন্ধুর নামে করা যায় না, শোভনও নয়! সুতরাং বিদ্যুৎ কেন্দ্র নয়, বানাও বঙ্গবন্ধু বিমানবন্দর, বানাও ফজিলাতুন্নেসা নৌবন্দর...

জনতার বিপক্ষে জনমতের বিরুদ্ধে
বঙ্গবন্ধুকে আমরা শ্রদ্ধা করি, বাংলাদেশের সবচেয়ে গৌরবময় অধ্যায়ের নায়ক ছিলেন তিনি। কিন্তু গরিব মানুষের ভিটেবাড়ি কেড়ে নিয়ে যে বঙ্গবন্ধুর 'নাম প্রতিষ্ঠা'র উদ্যোগ নিতে হয়, সেই বঙ্গবন্ধুকে আমরা চিনি না, সেই বঙ্গবন্ধু আমাদের লোক নন! যে সরকার জনতার বিপক্ষে জনমতের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়, সেই সরকারও আমাদের নয়।

জীবন যায়, যাক দু একটা, তবু রুখে দিন নামকরণের জন্য মরিয়া এই ম্যানিয়াকদের। 

Tags: , ,

About author

ফিউশন ফাইভ। ব্লগ লিখছেন পাঁচ বছরেরও বেশি সময় ধরে।

0 মন্তব্য

Leave a Reply