মানসিক যন্ত্রণায় কাতর এক সাংবাদিকের জবানবন্দি

কদিন আগেও তিনি ছিলেন দৈনিক যুগান্তরের সাংবাদিক। একজন জামাত নেতার দুর্নীতির বিরুদ্ধে লিখে এবং গোয়েন্দা সংস্থার কয়েকজন কর্মকর্তার হাতে নিগৃহীত হয়ে তিনি চাকরিটিও হারিয়েছেন। অবস্থা এমন যে, পরিবার-পরিজন নিয়ে তাকে পালিয়ে বেড়াতে হচ্ছে প্রতিরাতেই। মানসিক যন্ত্রণায় তিনি পা বাড়াতে চাইছেন আত্মহননের পথে । সেলিম জাহিদ নামে এই সাংবাদিকের জবানবন্দিটি পড়ুন-

"সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম আত্মাহুতি দেব। পরে ভাবলাম সংবাদ সম্মেলন করে বিষয়টি দেশবাসীকে জানানো উচিত। একটি দিনক্ষণও ঠিক করেছিলাম। পছন্দ করে এমন দু'জনকে সিদ্ধান্তের কথাটি জানালে একজন হাসলেন, অপরজন মুখ ফ্যাকাশে করলেন। প্রথমজন বললেন, সাংবাদিকরা আত্মাহুতির খবর লিখে, আর তুমি খবর হবে! দ্বিতীয়জন মন্তব্য করলেন, চরম অন্যায়ের শিকার হয়ে কোন মজলুমের মনে এমন নির্মম চিন্তা আসাটা অস্বাভাবিক নয়। তিনি হতাশ না হয়ে ধৈর্যের সঙ্গে সংক মোকাবেলার পরামর্শ দিলেন।
প্রচন্ড মানসিক যন্ত্রণার ভেতরেও যখন অবসন্ন শরীরে বাসায় ফিরি, আমার একমাত্র সন্তানটি তখন এক গাল হৃদয়স্পর্শী হাসি দিয়ে এক অসাধারণ মমতায় ‌আব্বু' শবইদট উচ্চারণ করে। এরপর বুকে জড়িয়ে নাকে মুখে ভালবাসার লালা ছড়ায়। ২০০৬ সালের ১৬ ডিসেম্বর মহান বিজয় দিবসের প্রথমার্ধে তার জন্ম। মানসিক যাতনায় দুঃসহ জীন নিয়ে আত্মাহুতির কঠিন সিদ্ধান্ত নিলেও বিজয়ে জন্মা সন্তানের কাছে আমি শেষ পর্যন্ত পরাস্ত হই। দ্বিগুণ মমতায় গড়ে তোলা মা-বাবা, আর ভাই-বোনদের কথা না হয় বাদই দিলাম।
প্রায় এক দশক ধরে প্রশ্নাতীত নিষ্ঠা ও সততার সঙ্গে দৈনিক আজকের কাগ (অধূনালপ্ত), ইনকিলাব, সমকাল ও যুগান্তর পত্রিকায় কাজ করেছি। সাংবাদিকতায় বিশেষ কৃতিত্বের জন্য ২০০৩ সালে মানিক মিয়া (ডিআরইউ) ও ২০০৫ সালে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল পুরস্কারে সম্মানিত হয়েছি। শত্রুও আমার চারিত্রিক সততা নিয়ে কখনও প্রশ্ন তুলতে পারেনি। বর্তমান তত্ত্বাবধায় কৎসরকার ও বাংলাদেশ সেনাবাহিনী যুগপৎভাবে দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিহাদ করছে। সামান্য সংবাদকর্মী হিসেবে আমিও এর অংশীদার। কিন্তু দুর্নীতির বিরুদ্ধে লিখতে গিয়ে এখন আমার কর্ম ও জীবন দু'টোই বিপন্ন। কিন্তু কেন. সেটিই আজ আমার লেখার বিষয়।
দৈনিক যুগান্তর পত্রিকায় আমি সিনিয়র রিপোর্টার হিসেবে র্মরত ছিলাম। পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে কুমিল্লা-১০ আসনের জামায়াতে ইসলামীর সাবেক সংসদ সদস্য প্রার্থী ও কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা জামায়াতের সহকারি সেক্রেটারি রেজাউল করিমের বিরুদ্ধে আমার ব্যাংক জালিয়াতি ও তার কিছু আর্থিক প্রতারণার অভিযোগ আসে। অভিযোগগুলো দীর্ঘ যাচাই বাচাইয়ের পর সাংবাদিকতার নিয়ম অনুসারে ০গ ৬ এপ্রিল ২০০৮ রেজাউল করিমের বক্তব্য জানার চেষ্টা করি। কিন্তু তিনি মোবাইল ফোনে বক্তব্য দিতে রাজি না হয়ে পরদিন আমাকে মতিঝিলে প‌্যাসেফিক হোটেলে সাক্ষাতের আমন্ত্রণ জানান। কথা মতো আমি সেখানে যাই এবং রেজাউল করিম তার বিরুদ্ধে অভিযোগের ব্যাপারে জানতে চাইলে তাকে বিস্তারিত অবহিত করি। অভিযোগ শুনে প্রথমে তিনি অস্বীকার করেন। এক পর্যায়ে জালিয়াতি ও প্রতারণার তথ্য উপাত্ত তুলে ধরলে রেজাউল করিম অত্যন্ত কাতরকণ্ঠে বিষয়টি আপস মীমাংসার প্রস্তাব দেন। এ সময় জামায়াতে ইসলামীর পল্টন থানা আমীর সিরাজুল হকও উপস্থিত ছিলেন।
আমি বিনয়ের সঙ্গে সমঝোতার ব্যাপারে অপারগতা প্রকাশ করে রেজাউল করিমকে জানাই, এ বিষয়ে আমার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ ওয়াকিবহাল। এ ব্যাপারে তার বাড়তি কিছু বলার থাকলে তিনি যেন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। আমি ওইদিনই যথারীতি রিপোর্টটি রেজাউল করিম ও জামায়াতের ইসলামীর আমীর মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীর বক্তব্যসহ জমা দেই এবং ৯ এপ্রিল তা যুগান্তরে প্রকাশিত হয়। রিপোর্টটি প্রকাশের আগে রেজাউল করিম কয়েকজন নেতৃস্থানীয় সাংবাদিকসহ বিভিন্ন মাধ্যমে আমাকে ম্যানেজ করার চেষ্টা চালান। সব চেষ্টা ব্যর্থ হবার পর গত ৭ ও ৮ এপ্রিল রাতে একটি বিশেষ গোয়েন্দা সংস্থার দু'জন পদস্থ কর্মকর্তা নিজেদের পরিচয় প্রকাশ করে ০১৯১৪১২৩৬১৮ ও ০১৫৫০১৫৩৬৪৯ নম্বর থেকে আমাকে রিপোর্ট প্রকাশের পরিণতি সম্পর্কে সতর্ক করেন।
এদের একজন নিজেকে রেজাউল করিমের সমন্ধি বলে পরিচয় দেন। অপরজন আমার বিরুদ্ধে রেজাউলের কাছ থেকে ৫০ হাজার টাকা চাঁদা চাওয়ার অভিযোগ তোলেন। আমি বিষয়টি তৎক্ষণাৎ যুগান্তরের উপ-সম্পাদক সাইফুল আলম ও চিপ রিপোর্টার রফিকুল ইসলাম রতনকে জানাই। সব কিছু জেনে বুঝে যুগান্তর কর্তৃপক্ষ ৯ এপ্রিল রিপোর্টটি প্রকাশ করে। রিপোর্ট প্রকাশের পর উল্ল্যখিত ব্যক্তিরা আরও ক্ষুব্ধ হয়ে আমার স্বাভাবিক জীবন বিপন্ন করার নানামুখী চেষ্টা চালান।
৯ এপ্রিল রাতে (রিপোর্ট প্রকাশের দিন) অফিসে গিয়ে শুনতে পাই, রেজাউল করিমের পক্ষ নিয়ে সংশ্লিষ্ট গোয়েন্দা কর্মকর্তারা যুগান্তরের চেয়ারম্যান নুরুল ইসলাম বাবুলের কাছে আমার বিরুদ্ধে ৫০ হাজার টাকা চাঁদা চাওয়ার অভিযোগ করে আমাকে চাকরিচু্ত করতে বলেন। অভিযোগ শুনে চেয়ারম্যান পত্রিকার উপ-সম্পাদক ও চিফ রিপোর্টারকে তার সেনাকল্যাণ ভবনের অফিসে ডেকে পাঠান। তারা চেয়ারম্যানকে জানান, প্রকাশিত রিপোর্টটি আমি অনেক আগেই জমা দিয়েছিলাম। কিন্তু রেজাউল করিমের বক্তব্য না থাকায় বার্তা সম্পাদক রিপোর্টটি রেখে দেন। সুতরাং রিপোর্ট আটকিয়ে চাঁদা চাওয়ার কোন সুযোগ নেই। এমনকি বক্তব্য না জানতে গেলে রিপোর্টটি সম্পর্কে রেজাউল করিমের জানারই কথা না।
এ পর্যায়ে বিষয়টি বুঝতে পেরে চেয়ারম্যান রিপোর্টের প্রতিবাদ আসলে তা গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশের নির্দেশ দেন। সে রাতেই রেজাউল করিমের একটি প্রতিবাদ আসে। কোন রকম বিরোধ এড়ানোর জন্য কর্তৃপক্ষ আমার বক্তব্য ছাড়াই প্রতিবাদটি রিপোর্ট প্রকাশের ওই স্থানটিতেই ছাপেন। যদিও প্রতিবাদের সঙ্গে আমি আমার বক্তব্য দিয়েছিলাম। আমার বক্তব্য ছাড়াই প্রতিবাদিলপি প্রকাশ হবার পর সংশ্লিষ্টরা এটাকে দুর্বলতা মনে করে আমার জীবন বিপন্ন করার নানামুখী তৎপরতা চালাতে থাকেন। বাধ্য হয়ে আমি ১০ এপ্রিল-২০০৮ মতিঝিল থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (নং-৬৬৮) করি।
ওই রাতে (১০এপ্রিল) পত্রিকার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ আমাকে জানান, সাধারণ ডায়েরির পর গোয়েন্দা কর্মকর্তারা আমার ওপর প্রচন্ড ক্ষুব্ধ হয়েছেন। তারা আমার বিরুদ্ধে যুগান্তর কর্তৃপক্ষ কী ব্যবস্থা গ্রহণ করে তার অপেক্ষায় আছেন। আমাকে জানানো হয়, সামরিক গোয়েন্দা সংস্থার একজন প্রভাবশালী কর্মকর্তা ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য যুগান্তরকে এক ঘণ্টা সময় বেঁধে দিয়েছেন। এ অবস্থায় কর্তৃপক্ষ জরুরি বৈঠকে বসে সিদ্ধান্ত নেন আমাকে বাধ্যতামূলক ছুটি দেবেন। অন্যদিকে ক্ষুব্ধ কর্মকর্তাদের অব্যাহতিদানের বিষয়টি নিশ্চিত করবেন। উপ-সম্পাদক ও চিফ রিপোর্টার আমাকে সতর্কভাবে চলাফেলা এবং বাসায় না থাকার পরামর্শ দিয়ে তৎক্ষণাৎ অফিস তাগের নির্দেশ দেন। ওই রাতেই আমি নিরাপত্তাহীন অবস্থায় যুগান্তর ত্যাগ করি এবং পরিবার নিয়ে আত্মগোপনে চলে যাই। সে থেকে চরম মানসিক যন্ত্রণার মধ্যদিয়ে আমার প্রতিটি দিন কাটে, রাত পোহায়। দশ বছরের চাকরি জীবনে প্রথমবারের মতো জীবন ও পেশাগত অনিশ্চয়তায় পড়ি। এই মানসিক যন্ত্রণার ভেতরেই যুগান্তর কর্তৃপক্ষ আমার ঢাকা ও গ্রামের ঠিকানায় দু'টি চিঠি পাঠান। ঢাকার ঠিকানায় পাওয়া চিঠির খাম খুলেই দেখতে পাই - বিষয় অব্যাহতি'। তিন লাইনের ওই অব্যাহতিপত্রে আমাকে লেখা হয়- আপনাকে চাকুরি থেকে অব্যাহতি দেয়া হলো। এই নির্দেশ ১৫ এপ্রিল থেকে কার্যকর হবে। আপনার পাওনার ব্যাপারে হিসাব বিভাগের সঙ্গে যোগাযোগ করবেন।' অব্যাহতিপত্র হাতে পেয়ে অমানিশার ঘোর অন্ধকার নেমে আসে আমার অন্তরাত্মায়। দু'চোখ ঘোলা হয়ে আসে। মনের অজান্তেই ঝরে পড়ে নোনা পানি।
দু'দিন পর গ্রাম থেকে আমার বাবা মোবাইল ফোনে জানান, ডাকযোগে যুগান্তর থেকে রেজিস্ট্রিকৃত একটি চিঠি এসেছে- তা তিনি গ্রহণ করবেন কিনা। লজ্জায় শঙ্কায় কিংকর্তব্যবিমুঢ হয়ে বাবাকে জানাই, ওই চিঠির একটি কপি আমিও পেয়েছি। এটি তার গ্রহণ করার দরকার নেই। আমার ওপর বয়ে যাওয়া ঝড়ের ঘটনাটি বড় ভাই ছাড়া বাবা-মাকে জানাইনি। কারণ এ ঘটনায় নিশ্চয়ই আরও ব্যথিত হতেন বাবা মা। দুশ্চিন্তায় ভারাক্রান্ত হয়ে রোগের উৎপীড়ন আরও বেড়ে যেত। আমার মা একজন ডায়াবেটিস রোগী। তার ডায়াবেটিসের মাত্রা ১৭ থেকে ২০এ ওঠানামা করছে। দিনে দুই বেলা লেনটাস ইন্সু্লিন নিতে হয় তাকে। ছেলের দুশ্চিন্তায় মা'র িবপন্নতা রোধেই এই গোপনীয়তার চেষ্টা।
আমি জানি না, আমার অপরাধটি কি। আমার চাকরিচু্তির আজ প্রায় দু' মাস। আমি নিশ্চিত, কোন গোয়েন্দা সংস্থার প্রাতিষ্ঠানিক চাপে আমার চাকরিচুতি হয়নি। আমি কয়েকজন গোয়েন্দা কর্মকর্তার ব্যক্তিগত অদৃশ্য আক্রোশের শিকার। বিষয়টি আমি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. ফখরুদ্দীন আহমদ, সেনাপ্রধান জেনারেল মইন উ আহমেদসহ বিভিন্ন সংস্থা এবং দেশের গণমাধ্যমের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের অবহিত করেছি। অবহিত করেছি দেশের কয়েকজন বিশিষ্ট সম্পাদককে। যারা এই কঠিন সময়ে পাশে দাঁড়িয়ে আমাকে সাহস যুগিয়েছেন। আমি লিখিতভাবে ঘটানাটি জানিয়েছি পেশাজীবী সংবাদকর্মীদের নিখাঁদ সংগঠন ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি, জাতীয় প্রেসক্লাব, দুইভাগে বিভক্ত বিএফইউজে ও ডিইউজে'র সভাপতি মহাসচিবকে।
আমার এই ঘটনায় সংবাদপত্রশিল্পের অভিভাবকদের অনেককে আহত করেছে। কিন্তু এখনও অবসান হয়নি আমার জীবনের বিপন্নতার, কর্মের অনিশ্চয়তার"

প্রথম প্রকাশ

Tags: ,

About author

ফিউশন ফাইভ। ব্লগ লিখছেন পাঁচ বছরেরও বেশি সময় ধরে।

0 মন্তব্য

Leave a Reply