ব্লগারদের বই নিয়ে আহমাদ মোস্তফা কামালের রিভিউ : ছাপা কাগজে একটুকরো 'ব্লগ'

গল্পকার-প্রাবন্ধিক এবং ব্লগার আহমাদ মোস্তফা কামাল ব্লগারদের বই নিয়ে সম্প্রতি একটি রিভিউ লিখেছেন বইয়ের জগতে। আমার সম্পর্কে নির্মম অপপ্রচার সেই রিভিউর একমাত্র নেতিবাচক দিক! এর বাইরে বাকি সবই চমৎকার। বলে রাখা ভালো, রিভিউটি তিনি করেছেন সেইসব পাঠকের কথা মাথায় রেখে, যারা 'ব্লগ' ব্যাপারটার সঙ্গেই পরিচিত নন, অনলাইনে লেখালেখির ব্যাপারটা যাদের বোধগম্যতার ভেতরে নেই। ফলে এই রিভিউতে অনেক প্রসঙ্গ নিয়ে তাকে কথা বলতে হয়েছে যেগুলো ব্লগারদের কাছে আদৌ 'নতুন' কিছু মনে হবে না। অপরবাস্তব শুধু নয়, এই রিভিউ একইসঙ্গে মূলধারায় 'ব্লগ'কে উপস্থাপনের কাজটিও করেছে। ঢাকা থেকে প্রকাশিত 'বইয়ের জগৎ' সাময়িকীর দাম ৮০ টাকা। মূল্যে শুধু নয়, আয়তন আর মানেও প্রায় আড়াইশো পৃষ্ঠার সাময়িকীটি ওজনদার। বই সমালোচনা নিয়ে সম্ভবত এই মানের কোনো সাময়িকী আগে দেখিনি।

---
‌অপরবাস্তব : সাহিত্যচর্চার নতুন ধরন
আহমাদ মোস্তফা কামাল

একটি অভিনব গ্রন্থের সঙ্গে আপনাদেরকে পরিচয় করিয়ে দেবার জন্য লিখতে বসেছি, প্রিয় পাঠক। অভিনব এই অর্থে যে, এই গ্রন্থের সম্পাদক এবং অধিকাংশ লেখকদের সঙ্গে মূলধারার পাঠকরা তো পরিচিত ননই, এমনকি এটি যে প্রক্রিয়ায় প্রকাশিত হয়েছে তার সঙ্গেও পরিচিত নন। বইটির নাম- ‘অপরবাস্তব’, সম্পাদক- লোকালটক, এবং এটি অনলাইনে বাংলাভাষায় লেখালেখির সঙ্গে জড়িত লেখকদের গল্প সংকলন। তবে বিস্তারিত পরিচয়ের আগে অনলাইনে লেখালেখি সম্বন্ধে কিছু কথা বলে নেয়া দরকার।
গত এক দশকে সাহিত্যচর্চার ক্ষেত্রে সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনার একটি হলো- ইন্টারনেট প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে অনলাইনে লেখালেখির চর্চার উদ্ভব হওয়া। অন্যান্য ভাষায় ব্যাপারটি অনেক আগেই শুরু হলেও বাংলা ভাষায় এবং বাংলাদেশে এর উদ্বোধন হয় ১৬ ডিসেম্বর, ২০০৫ সালে সামহোয়ারইন ব্লগ-এর মাধ্যমে। সাহিত্যচর্চার ক্ষেত্রে ঘটনাটি বাংলাদেশে একেবারেই নতুন বলে মূলধারার সাহিত্যজগতে এটি এখনো তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য প্রভাব তৈরি করতে পারেনি বটে, বা মূলধারার সাহিত্য-আলোচনায় অনলাইন লেখকদের কথা উল্লেখিত হয় না বটে, তবে আগামী দশকের শেষে গিয়ে হয়তো দেখা যাবে- এটি বিকল্প গণমাধ্যমের এক গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ হয়ে উঠেছে, এবং হয়তো সেদিন সাহিত্য-আলোচনায় এই লেখালেখিকে আর অস্বীকার করার উপায় থাকবে না। প্রিন্ট মিডিয়ায় লেখালেখির সঙ্গে অনলাইন মাধ্যমে লেখালেখির মূল পার্থক্যগুলো চিহ্নিত করা যায় এভাবে- ১. এখানে কোনো সম্পাদকীয় শাসন-অনুশাসন নেই, ফলে যে-কেউ যে-কোনো ধরনের লেখা প্রকাশ করার অধিকার রাখেন। সেই অর্থে এটি অনেক মুক্ত ও স্বাধীন মাধ্যম। ২. এই মাধ্যমে লেখক-পাঠকদের মধ্যে পাস্পরিক মিথস্ক্রিয়া অত্যন্ত চমৎকার। লেখা প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে পাঠকরা তাদের মতামত জানাতে থাকেন, কোনো প্রশ্ন থাকলে প্রশ্ন করেন, কোনো পরামর্শ থাকলে সেটিও লেখককে জানিয়ে দেন। লেখকও এইসব প্রশ্নের উত্তর দেন, মতামতের ব্যাপারে তার নিজস্ব অবস্থানটি পরিষ্কার করেন। একটি লেখা এইসব বিবিধ মতামত নিয়েই পূর্ণাঙ্গ হয়ে ওঠে এবং অধিকতর আকর্ষণীয় রূপে পাঠকদের কাছে হাজির হয়। ৩. এখানে লেখক-পাঠকদের সম্পর্ক এক তরফা নয়! একজন লেখক একইসঙ্গে পাঠকও, বা একজন পাঠক একসঙ্গে একজন লেখকও। ফলে পরস্পরের সঙ্গে মতবিনিময় করার একটি চমৎকার মাধ্যম হয়ে উঠেছে এটি। ৪.লেখাগুলো সাধারণত উন্মুক্ত থাকে এবং পৃথিবীর যে-কোনো স্থান থেকে যে-কেউ যে-কোনো সময় সেগুলো পড়বার স্বাধীনতা ভোগ করে থাকেন। অর্থাৎ ছাপা-বইয়ের যেমন দুষ্প্রাপ্যতার একটা ব্যাপার আছে, চাইলেই যে-কোনো সময় যে-কোনো পাঠক সেটি পড়তে পারেন না, অনলাইনে সেই দুষ্প্রাপ্যতা নেই।

যেমনটি আগে বলেছি- বাংলাদেশে অনলাইনে লেখালেখির সূত্রপাত ঘটে সামহোয়ারইন ব্লগ-এর মাধ্যমে ২০০৫ সালের শেষের দিকে। এর মধ্যেই বাংলাদেশে আরো কয়েকটি ব্লগ চালু হয়ে গেছে। যেমন সচলায়তন, আমার ব্লগ, প্রথম আলো ব্লগ, মুক্তাঙ্গন ব্লগ ইত্যাদি। এ ছাড়া ব্লগস্পটেও ব্যক্তিগত ব্লগ বানিয়ে বাংলায় লিখছেন অনেকেই। শুনে অবাক হবেন প্রিয় পাঠক, এই সব ব্লগ মিলিয়ে এখন লেখকের সংখ্যা প্রায় অর্ধলাধিক! পৃথিবীর নানা প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা বাংলা ভাষাভাষীদের কাছে ব্লগ হয়ে উঠছে পরম আদরনীয় এক মুক্ত যোগাযোগ মাধ্যম। মাত্র চার বছরেই বাংলা ব্লগগুলোর এই অভাবিত জনপ্রিয়তাই প্রমাণ করে দেয়- আগামী দিনে এই মাধ্যমটিকে হেলাফেলা করার কোনো সুযোগই আর থাকবে না। ব্লগ সম্পর্কে অপরবাস্তব-এর সম্পাদকীয় থেকে কিছু অংশ তুলে দিয়ে বইয়ের আলোচনায় প্রবেশ করবো- ‘ওয়েবব্লগের সংক্ষেপিত রূপ- ব্লগ। অনলাইন জার্নাল বা ডায়েরি। দিনে দিনে ব্লগ হয়ে উঠছে একমাত্র ইন্টারঅ্যাকটিভ মিডিয়া, বিকল্প গণমাধ্যম- যা বিশ্বের নানা প্রান্তের মতামত-প্রতিক্রিয়াগুলোকে ধারণ করছে। ব্লগ যেভাবে উঠে আসছে, তাতে এটি ছাড়িয়ে যেতে পারে সংবাদপত্র, এমনকি টেলিভিশনকেও। যদিও টেলিভিশনের মতো ব্যাপক প্রভাব এখনো ব্লগের হয়ে ওঠেনি, তবুও টেলিভিশন ও সংবাদপত্র যা পারে না- ব্লগ তা পারছে। পাঠক ও লেখকদের কিংবা দর্শক ও নির্মাতাদের মধ্যে সত্যিকারের বিনিময় ব্লগেই সম্ভব হচ্ছে।’

এবার ‘অপরবাস্তব’ প্রসঙ্গ। এটি মূলত সামহোয়ার ইন ব্লগ-এ যারা লেখালেখি করেন, তাদের গল্প নিয়ে একটি সংকলন। উল্লেখ করা দরকার যে, এই ব্লগটিই বাংলা ভাষায় প্রথম কমিউনিটি ব্লগিং-এর সূচনা করে। দেশ-বিদেশের হাজার হাজার বাংলাভাষী ব্লগার (এখানে লেখক-পাঠকের একটিই নাম- ব্লগার) এখানে নানা বিষয়ে প্রতিদিনই প্রচুর লেখা লিখে চলেছেন। শুধু গল্প-কবিতাই নয়, নানা বিষয়ে প্রবন্ধ, রাজনীতি-অর্থনীতি-বিজ্ঞান-ইতিহাস-ঐতিহ্য-সংগীত-ধর্ম-দর্শন-চলচ্চিত্র-বিনোদন প্রভৃতি বিষয়ে নানা ধরনের বিশ্লেষণ নিয়ে প্রতিদিনই নানা ধরনের লেখা পাওয়া যাচ্ছে। ‘অপরবাস্তব’-এর সম্পাদক এসব লেখা থেকে ব্লগারদের কাছ থেকে বছরের উল্লেখযোগ্য লেখাগুলো নির্বাচনের জন্য মনোনয়ন আহ্বান করেন ২০০৮ সালের নভেম্বর মাসে। প্রায় একমাস ধরে ব্লগাররা মনোনয়ন দিতে থাকেন। তর্ক-বিতর্কও হয় প্রচুর। শুরুতে কেবলমাত্র সেরা লেখাগুলো বাছাইয়ের জন্য এই মনোনয়ন আহ্বান করা হলেও শেষ পর্যন্ত এসব লেখা থেকে বাছাই করে একটি বিষয়ভিত্তিক গ্রন্থ প্রকাশের উদ্যোগ নেন সম্পাদক। নির্বাচিত লেখাগুলো থেকে গল্পগুলোকে আলাদা করে সেখান থেকে নির্বাচনের নতুন প্রক্রিয়া শুরু হয় খানিকটা গোপনীয়ভাবে। কয়েকজন ব্লগারের সমন্বয়ে একটি গ্র“প খোলা হয় যেখানে শুধু মাত্র ওই কয়েকজনই প্রবেশ করতে পারবেন, অন্যরা নন। অর্থাৎ হাজার হাজার ব্লগারের প্রাথমিক মনোয়নয়ন শেষে চূড়ান্ত নির্বাচনের জন্য বিষয়টিকে সীমাবদ্ধ করে ফেলা হয় কয়েকজন ব্লগারের মধ্যে। তারা যথাসময় তাদের মতামত ও নির্বাচন জানিয়ে দেন। মজার ব্যাপার হলো- পুরো ব্যাপারটিই ঘটে অনলাইনে। এই সম্পাদক ও নির্বাচকরা পরস্পরের সঙ্গে একবারও মুখোমুখি বসেননি, পরস্পরকে তারা চেনেনও না, এমনকি বইটি প্রকাশ হয়ে যাওয়ার পরও এর সম্পাদককে এখন পর্যন্ত প্রকাশ্যে দেখা যায়নি! যাহোক, নির্বাচন শেষে সম্পাদক নিজেই বইটির চূড়ান্ত রূপ দেন- অর্থাৎ প্রুফ দেখা, মেকাপ দেয়া ইত্যাদি শেষে তিনি পাণ্ডুলিপির সফটকপিটি পাঠিয়ে দেন প্রকাশকের কাছে। অদ্ভুত ব্যাপার হলো, প্রকাশকও নাকি এই সম্পাদককে আজতক দেখেননি! এরকম অভূতপূর্ব উপায়ে যে একটি বই প্রকাশিত হতে পারে, সেটি বিশ্বাস করাই কঠিন। ঘটনাক্রমে গল্প-নির্বাচকদের মধ্যে আমি নিজেও একজন ছিলাম বলে এর পূর্বাপর দেখার সুযোগ হয়েছে। এই পুরো বিষয়টি নিয়ে সংক্ষেপে সম্পাদকীয়তে বলা হয়েছে- ‘মুক্ত গণমাধ্যমের মুক্ত মতামত কেমন হতে পারে, সে ধারণা আমাদের অনেকেরই আছে। কিন্তু মুক্ত গণমাধ্যমের সাহিত্য- গল্প, কবিতা, উপন্যাস- তাও কি সম্ভব? সে প্রশ্নের উত্তর খুঁজতেই ব্লগের নির্বাচিত লেখা নিয়ে ২০০৭ ও ২০০৮ সালে প্রকাশিত হয়েছিল ‘অপরবাস্তব’।... এবার বিষয় হিসেবে নির্বাচন করা হয়- গল্প। এজন্য ব্লগারদের কাছ থেকে মনোনয়ন আহ্বান করা হয়েছিল গত বছরের নভেম্বরে। একমাসেরও বেশি সময় ধরে মনোনয়ন গ্রহণের পর নির্বাচিত গল্পগুলো ব্লগারদের সমন্বয়ে গঠিত একটি নির্বাচক প্যানেলের কাছে পাঠানো হয়। একমাস ধরে যাচাই-বাছাই শেষে ২৫টি গল্প চূড়ান্ত হয়, যা স্থান পেয়েছে এই সংকলনে। এর বাইরেও বেশ কিছু ভালো গল্প থেকে গেছে, দুর্মূল্যের বাজারে কলেবর বৃদ্ধির শঙ্কায় যা আমরা বইয়ে স্থান দিতে পারিনি। বলাবাহুল্য, এই সংকলনের গল্পকাররা ব্লগার, পাঠকরাও তেমনি, এমনকি পুরো এক বছরের গল্প থেকে যারা মনোনয়ন দিয়েছেন, সম্পাদনা যারা করেছেন, এমনকি যিনি প্রকাশক- সবার পরিচয় একটিই- ব্লগার।’

এবার গল্প প্রসঙ্গ। এই বইটিতে যাদের গল্প গ্রন্থিত হয়েছে তারা প্রধানত তরুণ গল্পকার এবং এদের অধিকাংশই গল্প লেখা শুরু করেছেন মাত্র দু-তিনবছর আগে। ব্লগই তাদের প্রথম গল্প-প্রকাশ মাধ্যম। পত্রপত্রিকায় অনেকেরই আজ পর্যন্ত কোনো লেখাই ছাপা হয়নি। লেখকদের তালিকাটিতে একবার চোখ বুলিয়ে দেখলে ব্যাপারটা আরো ভালোভাবে বোঝা যাবে- অনীক আন্দালিব, আবদুর রাজ্জাক শিপন, আবু কায়েস কুন্তল, একরামুল হক শামীম, কৌশিক আহমেদ, তানজিলা আফরিন, তারিক স্বপন, তানভীরুল ইসলাম, নুশেরা তাজরীন, নিবিড় ইসলাম, ফাহমিদুল হক, মনজুরুল হক, মাজুল হাসান, মাহবুব লীলেন, মাহবুব শাহরিয়ার, মাহমুদ আরিফ, মোস্তাফিজ রিপন, রন্টি চৌধুরী, লাবণ্য প্রভা, শফিউল আলম ইমন, সাইফুল ইসলাম ও সুমন রহমান। এদের মধ্যে ফাহমিদুল হক, মনজুরুল হক, মাজুল হাসান, মাহবুব লীলেন, লাবণ্য প্রভা ও সুমন রহমান ছাড়া অন্য সবাই মূলধারার পাঠকদের কাছে অপরিচিত নাম, যদিও ব্লগে তারা যথেষ্ঠই খ্যাতিমান। যাহোক, এই তরুণতর লেখকদের লেখাগুলোকে আমরা কীভাবে বিচার করবো? আমি নিজে সবসময়ই তরুণদের লেখাকে একটু ঔদার্যের সঙ্গে গ্রহণ করতে চাই। এমনিতেই তাদের অনেক বিপদ- প্রথমত একটা লেখাকে অন্তত লেখার মর্যাদায় নিয়ে যাওয়াই এক বড় বিপদ, তারপর লেখা প্রকাশ করা, প্রকাশিত হওয়ার পর সেটা পাঠকের কাছে পৌঁছানো, পৌঁছলো তো সেটা সম্বন্ধে দু-চারজন দরদী পাঠকের প্রতিক্রিয়া পাওয়া- সবই একজন তরুণ লেখকের জন্য কঠিন কাজ। তারচেয়ে বিপদজনক ব্যাপার হলো- একজন তরুণ লেখকের কাছ থেকে পাঠকরা সবসময় নতুন কিছু চায়। প্রশ্ন হচ্ছে এই পাঠকরা একজন তরুণের কাছে নতুন কিছু চায় কেন? এই প্রত্যাশার কারণ কি? কারণটা সম্ভবত এই যে, পাঠকরা বুড়ো লেখকদের লেখা পড়তে পড়তে ক্লান্ত-বিরক্ত (বিধ্বস্তও বলা যেতে পারে) হয়ে পড়েন। পুনরাবৃত্তির ভারে আক্রান্ত প্রবীণ লেখকদের লেখা নতুনত্বের সন্ধানী পাঠককে তো বটেই এমনকি স্বয়ং ওই লেখকদেরকেও ত্যক্তবিরক্ত করে তোলে। তরুণরা নতুন চিন্তা করবে, নতুন কথা বলবে কিংবা পুরনো কথাই এমনভাবে বলবে যেন নতুনের মতো শোনায়- এ-তো স্বাভাবিক প্রত্যাশ্যা। বিষয়গুলো বুঝেও এদের লেখায় আমি নতুন কিছু খুঁজে পেতে চেয়েছি। পাওয়া কি গেলো? হ্যাঁ, গেলো। প্রমাণ হিসেবে আপনি মাত্র তিন/চারটে গল্প পড়ে দেখতে পারেন। অনীক আন্দালিব, তারিক স্বপন, তানভীরুল ইসলাম, বা মোস্তাফিজ রিপন- এই যে অপরিচিত নামগুলো, তাদের গল্পগুলো পড়লে আপনি নিশ্চিতভাবেই বিস্মিত হবেন। গল্পের বিষয়, নির্মাণকৌশল, ভাষাভঙ্গি, শব্দের ব্যবহার, বাক্যগঠনের ধরণ ইত্যাদি দেখে আপনি বুঝতেই পারবেন না, এগুলো গুলো তরুণ গল্পকারের প্রথমদিকের গল্প- এমনি মনকাড়া সেগুলো। শুধু এদের কথাই বলি কেন! বয়সে এদের চেয়ে একটু বড়ো কৌশিক আহমেদ এবং নুশেরা তাজরীনের গল্প দুটোও কি মন কেড়ে নেবে না পাঠকের! নুশেরার নিখুঁত ভাষাজ্ঞান, নির্ভুল শব্দচয়ন ইত্যাদি আমাকেও অনেক সময় ধাঁধায় ফেলে দিয়েছে। মনে হয়েছে, বাংলাভাষাটি এত ভালোভাবে আমিও শিখিনি। সাইফুল ইসলাম, তানজিলা আফরিন, একরামুল হক শামীমের মতো অতি তরুণ লেখকেরাও আপনার দৃষ্টি কাড়বে, আমি নিশ্চিত। ব্লগে লেখার সুবাদে এই লেখকদের সবার সঙ্গেই আমি কমবেশি পরিচিত। শুধু গল্পই নয়, তাদের অন্য যে-কোনো ধরনের লেখাই যথেষ্ঠ চিন্তার খোরাক জোগায়। এই লেখকেরা পত্রপত্রিকায় লেখেন না বলে, বা লিটল ম্যাগাজিনের গোষ্ঠীবদ্ধতা তাদের নেই বলে বৃহত্তর পাঠক সমাজের কাছে তাদের নাম পৌঁছায়নি বটে, তবে ভবিষ্যতেও পৌঁছবে না সেটা বলা যায় না। বাংলাদেশের খুব কম সংখ্যক মানুষ এই মুহূর্তে ইন্টারনেট সুবিধা ভোগ করতে পারে। আবার যাদের ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগ রয়েছে তারা ‘ব্লগ’ ব্যাপারটার সঙ্গে একবারেই পরিচিত নন। তবে ব্লগের ক্রমবর্ধমান বিকাশ দেখে মনে হচ্ছে, ক্রমশই এই বিষয়টি তরুণ সমাজের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ছে। যারা কোনোদিন লেখার কথা ভাবেনওনি, তারাও হয়তো লিখতে শুরু করেছেন। লিখতে লিখতেই শিখে গেছেন, আলোচনা সমালোচনা উপদেশ পরামর্শ তাদেরকে ধীরে ধীরে গড়ে তুলছে। আর এখানেই ব্লগ অন্যান্য যে কোনো মাধ্যমের থেকে আলাদা ও অধিকতর আকর্ষণীয়। সম্মিলিত অংশগ্রহণের মাধ্যমেই এখানে একজন লেখকের গড়ে ওঠার প্রাথমিক কাজটি সম্পন্ন হয়।

আরেকটি প্রসঙ্গ বলে এই রচনার ইতি টানবো। ব্লগে এখন পর্যন্ত বেশিরভাগ লেখক ছদ্মনামে লেখালেখি করেন। বাংলা-ব্লগের প্রাথমিক বিকাশের সময় এটিকেই সবচেয়ে দূর্বল ও তিকর দিক বলে মনে হয় আমার। ছদ্মনামে লেখেন বলে অনেকেই (সবাই নন) এই মাধ্যমটির অপব্যবহারও করেন। আর সেজন্যই ব্লগ বিষয়টি যতোখানি আকর্ষণীয় হবার কথা ছিলো ততোখানি হয়নি। অপরবাস্তব প্রকাশের সময় গল্প-লেখকরা তাদের ছদ্মনামের বদলে প্রকৃত নাম ব্যবহার করে বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়েছেন, এবং এটি নির্বাচক-পর্ষদেরই সিদ্ধান্ত ছিলো। তাদেরকে সাধুবাদ। তবে বইটির সম্পাদক এখন পর্যন্ত ধরাছোঁয়ার বাইরেই রয়ে গেলেন। তিনি কোনোভাবেই নিজের পরিচয় প্রকাশে আগ্রহী নন!
অপরবাস্তব যারা পড়তে চান তারা আজিজ মার্কেটের দোতলায় ‘কিংবদন্তি’তে খোঁজ নিতে পারেন।
-
অপরবাস্তব
সম্পাদক : লোকালটক
প্রকাশক : রাশেদ হাফিজ, ছাপাকল।
মূল্য : ১০০ টাকা।

লেখাটির বিষয়বস্তু(ট্যাগ/কি-ওয়ার্ড): banglablogবাংলা ব্লগbangladeshdhakabangla blogsomewherein...blogsomewhereinblogFusion5fusion fiveahmad mostafa kamalbook reviewboier jagatoporbastoboporbastablocaltalk ;
প্রথম প্রকাশ

Tags: , ,

About author

ফিউশন ফাইভ। ব্লগ লিখছেন পাঁচ বছরেরও বেশি সময় ধরে।

0 মন্তব্য

Leave a Reply